যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহোর বাসিন্দা শারালী আর্মিটেজ হাওয়ার্ড। পেশায় একজন গ্রন্থাগারিক। কেটে ফেলা শতবর্ষী গাছের গুঁড়ি কাজে লাগিয়ে তৈরী করেছেন ক্ষুদ্রাকৃতির একটি গ্রন্থাগার। সেই গল্পই শোনাচ্ছেন আনিকা তাবাচ্ছুম।
গাছ এই নামটি শুনলেই সবার প্রথমে আপনার মাথায় কী আসে বলুন তো! ফল, ফুল কিংবা ছায়া? আমরা সব সময় দেখে এসেছি গাছ আমাদের অক্সিজেন প্রদানের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সাহায্য করে, ঋতুভেদে নানা ধরনের ফুল উপহার দেয়, অমৃত স্বাদের ফল দেয়, তপ্ত গরমে ছায়া প্রদান করে তাইনা!
কিন্তু আপনাদের এমন একটি গাছের গল্প বলি যে গাছকে জ্ঞান বিতরণের মাধ্যম হিসেব ব্যবহার করা হয়েছে। খুব অদ্ভুত শুনাচ্ছে তাইনা?
শুনতে অদ্ভুত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহোর বাসিন্দা শারালী আর্মিটেজ হাওয়ার্ড বাস্তবে তা করে দেখিয়েছেন। ভদ্রমহিলা পেশায় একজন গ্রন্থাগারিক। গ্রন্থাগারিকতার পাশাপাশি তিনি একজন শিল্পী ও বই বাঁধাইকারী হিসেবে কাজ করেন।
বছর দশেক আগে তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহোতে একটি বাড়ি ক্রয় করেন। বাড়ির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল ১১০ বছর বয়স্ক গাছ। এক কথায় গাছটি তাদের প্রতিবেশীর মত। কিন্তু বয়সের ভারে ধীরে ধীরে গাছটির ডাল গুলোতে পচন ধরছিল৷
আর এর মাধ্যমেই গল্পের শুরু। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে দূর্ভাগ্যবশত গাছটির একটি ডাল ভদ্রমহিলার ব্যক্তিগত গাড়ির উপর ভেঙে পরে, যার ফলে গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছুদিনের ব্যবধানে বাড়ির আঙিনায় আরো ডাল ভেঙে পরতে থাকে। যার ফলে এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করতে বাধ্য হয় মিসেস হাওয়ার্ডের পরিবার। কেননা গাছের ভেঙে যাওয়া ডাল থেকে যেকোনো সময় হতাহত হওয়ার আশংকা থেকেই যায়। তারা গাছটিকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়। মিসেস হাওয়ার্ড ও তার পরিবার গাছটিকে খুব পছন্দ করতেন কিন্তু কী আর করার বড় ধরনের দূর্ঘটনা এড়াতে গাছটি কেঁটে ফেলা জরুরি। শৈল্পিক চিন্তাধারার অধিকারী মিসেস হাওয়ার্ড শতবর্ষী গাছটির শেষ স্মৃতি রক্ষার্থে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি উদ্যোগ নিলেন। গাছটির পঁচে যাওয়া ডাল-পালা গুলো কেঁটে ফেলা হলেও তিনি গাছের নিম্নাংশ না কেটে রেখে দিয়েছিলেন। একজন গ্রন্থাগারিকের বুদ্ধিমত্তা ও শিল্পির সৃজনশীলতাকে পুঁজি করে গাছটির নিম্নাংশ দিয়ে তৈরি করলেন ক্ষুদ্রাকৃতির একটি গ্রন্থাগার। সৃষ্টি হলো বৃক্ষগ্রন্থাগারের, এক শিল্প মনা গ্রন্থাগারিকের শিল্পকর্ম!
গাছের নিম্নাংশটি অর্থাৎ অবশিষ্ট গুড়িটির উচ্চতা প্রায় ১০ ফুট। মিসেস হাওয়ার্ড তার স্বামীর সহোযোগিতায় গাছের গুড়িটিকে লম্বাকৃতির ঘরে রূপ দিয়ে তাতে ছায়াবৃত ছাদ যুক্ত করে দিয়েছিলেন। ছাদটি অনেকটা চৌচালা ঘরের চালের ন্যায় চারিদিকে কিছুটা বর্ধিত। বৃক্ষ গ্রন্থাগারটির অভ্যন্তরে একটি ফানুস আকৃতির বাতি রয়েছে। যা অন্ধকারে আলোর ব্যবস্থা করে। গ্রন্থাগারটিতে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য তার পরিবারের সদস্যরা কিছু কৃত্রিম বইয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। ক্ষুদ্রাকৃতির কৃত্রিম বইগুলো বৃক্ষ গ্রন্থাগারটির দরজায় পেরেকের সাহায্য ঝুলিয়ে দেয়া হয়। কৃত্রিম বইগুলোর মধ্যে Call of the Wild, Nancy Drew এবং The Grapes of Wrath এর মত ক্ল্যাসিক বইয়ের পাশাপাশি Hush Little Alien, Harry Potter এবং Percy Jackson এর মত সমসাময়িক জনপ্রিয় বইগুলোও রয়েছে। প্রতিটি কৃত্রিম বইয়ে ৩টি করে লাইন রয়েছে যার প্রতি লাইনে ৭টি করে অক্ষর রয়েছে।
তবে গ্রন্থাগারের প্রকৃত বইগুলোর দেখা মিলে প্রাচীন জানালা দেয়া দরজার ওপারে। গ্রন্থাগারের দরজাটি এমন উপাদানে তৈরি, যা দেখলে মনে হয় কোন মধ্যযুগীয় ঘরের দরজা। যা এটিকে একটি ভিন্নধর্মী নান্দনিকতা প্রদান করেছে। মিসেস হাওয়ার্ড ও তার পরিবার শিশুদের পছন্দকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মিসেস হাওয়ার্ডের প্রতিবেশী শিশুরা, সহকর্মীরা, বাচ্চাদের স্কুলের বন্ধুরা প্রায়ই তার গ্রন্থাগারটিতে আসেন। তাই এই উন্মুক্ত বৃক্ষ গ্রন্থাগার থেকে শিশুরা বই ধার নেয়। আবার অনেকে এই গ্রন্থাগারের সংগ্রহ বৃদ্ধিকরণে মিসেস হাওয়ার্ডকে বই উপহার দেন। এটি খুবই সুন্দর একটি প্রক্রিয়া।
ভদ্রমহিলা ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর তার ব্যক্তিগত ফেইসবুক একাউন্টে বৃক্ষ গ্রন্থাগারটির কিছু ছবি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করেন। আইডাহোর স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো তার এই উদ্যোগ একটি রিপোর্ট আকারে প্রকাশ করে। যা স্থানীয় জনগণের মাঝে খুবই ইতিবাচক সারা ফেলে। পরবর্তীতে জাতীয় প্রকাশনাগুলি তার বৃক্ষ গ্রন্থাগারের গল্প ছাপায়। ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবীর বই প্রেমীরা মিসেস হাওয়ার্ডের এই প্রশংসনীয় কাজ সম্পর্কে জানতে শুরু করে। অনেকে তাকে অনুকরণ করে এমন ক্ষুদ্র গ্রন্থাগার গড়ে তুলে।
একজন প্রকৃতিপ্রেমীর এই অনন্য উদ্যোগ জ্ঞানবিতরণকে একটি অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। এই কাজের মাধ্যমে একদিকে তিনি যেমন গ্রন্থাগারিক পেশাকে সম্মানিত করেছেন তেমনি চলমান গ্রন্থাগার আন্দোলনকে প্রসারিত করেছেন। নিঃসন্দেহে তার এই উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাই এমন ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিলে জ্ঞান চর্চার পথ দিনে দিনে অনেক অগ্রসর হবে।
লেখকঃ আনিকা তাবাচ্ছুম গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিভাগ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, লালমাটিয়া, ঢাকা।
তথ্যসূত্র : www.littlefreelibrary.org
ছবিঃ এটলাস ওবসকিউরা, পিন্টারেষ্ট