এস এম সাব্বির আকন্দ
‘আমারা যতবেশী লাইব্রেরী স্থাপন করব, দেশের তত বেশী উপকার হবে। আমার মনে হয় , এদেশে লাইব্রেরির স্বার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল কলেজের চাইতে একটু বেশী।’– প্রমথ চৌধুরী
একটি জাতির মেধা ও মনন , ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারণ ও লালনকারী হিসেবে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে। সেজন্য বলা হয় গ্রন্থাগার সমাজ উন্নয়নের বাহন। আমাদের দেশের সরকার প্রধানগণও গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করে বিভিন্ন সময় গ্রন্থাগারমূখী ব্যাপক উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহন করেন। উদাহারণ স্বরুপ বলা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশে অনেক সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘জাতীয় গ্রন্থাগার’। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার স্থাপন এবং গ্রন্থাগারে সহকারি গ্রন্থাগারিকের একটি করে পদ সৃষ্টি করেন ।
বিগত ১০ বছরে এক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি থাকলেও বর্তমানে কলেজ গ্রন্থাগারগুলোর আশানুরুপ উন্নয়ন হয়নি। সারাদেশে ২৩৭৫টি কলেজে অনার্স মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। এর মধ্যে ৯০% কলেজের গ্রন্থাগারের জন্য আলাদা গ্রন্থাগার ভবন নেই। মোট গ্রন্থাগারের ৯০% থেকে ৯৫% গ্রন্থাগারে সকল প্রকার গ্রন্থাগার সেবা চালু নেই। দেশের অনেক কলেজ আছে যেখানে গ্রন্থাগারিক বা সহকারী গ্রন্থাগারিকের কোন পদ নেই অথবা পদআছে কিন্তু ১৫ থেকে ২০ বছরেও কাউকে নিয়োগ বা পদায়ন করা হয়নি।
কলেজগুলোর স্নতাতক পাস ডিগ্রীর উপর ভিত্তি করে গ্রন্থাগারিক এবং সহকারী গ্রন্থাগারিকের ২টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল শুরুর দিকে। কিন্ত বিগত ১০ বছরে প্রায় সকল কলেজেই অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য ডিগ্রী প্রদান করা হচ্ছে।সেই সাথে এক একটি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে অনেকগুণ। অনেক কলেজের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও অনেক বেশী। কিন্ত বাড়েনি গ্রন্থাগারের জনবল এবং আয়তন।অথচ এখন থেকে ৩০ বছর আগে অনেকগুলো পুরাতন কলেজে আলাদা গ্রন্থাগার ভবন ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ছিল।কিন্তু বিগত ২০ বছরে নতুন করে গ্রন্থাগারের জন্য আলাদা ভবন হয়েছে এমনটা চোখে পড়েনি। অথচ যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট ছাত্র-ছাত্রীর ১০-২০% ছাত্র-ছাত্রী যেন পড়তে পারে সেই সুযোগ থাকা অত্যান্ত জরুরী। ১৯৭৪ সালে খুদ্রাত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে গ্রন্থাগারকে শিক্ষা প্রতিষ্টানের প্রাণকেন্দ্র বলা হয়েছে। গ্ররন্থাগারের গুরুত্ব বুঝাতেআরও বলা হয়েছে- সত্যি যদি আমরা গতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থা চাইতবে গ্রন্থাগারের উন্নয়ন অবশ্যম্ভাবী। মোট কথা আমারা যদি জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গঠন করতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে গ্রন্থাগারের উন্নয়নে সুনজর দিতে হবে।
গ্রন্থাগারের উন্নয়নে বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন ও বিজ্ঞজনের বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দিয়েছেন। তার আলোকে নিম্নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারের উন্নয়নে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি-
- ১. প্রতিষ্ঠানের মোট ছাত্র-ছাত্রীর ১০-২০% ছাত্র-ছাত্রী যাতে একসাথে পড়ার সুযোগ পায় সেরকম গ্রন্থাগার অবকাঠামো স্থাপন করা।
- ২. বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের মত কলেজ গ্রন্থাগারগুলোতেও সকল প্রকার গ্রন্থাগার সেবা নিশ্চিত করা।
- ৩. আন্তঃগ্রন্থাগার রিসোর্স শেয়ারিং চালু করা।
- ৪. পাঠকের জন্য উন্মুক্ত কপিরাইটবিহীন সকল প্রকাশনার ইলেক্ট্রনিক্স ভার্সন গ্রন্থাগারে সংরক্ষন করা।
- ৫.প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদত্ত ডিগ্রী এবং প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবলের জন্য পদ সৃজন করা এবং একটি সমন্বিত নিয়োগ বিধি প্রণয়ন করা।
- ৬। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য যথাযথ কর্মসুচী গ্রহণ করা।
- ৭। গ্রন্থাগারে কর্মরত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের পদোন্নতির সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা এবং তাদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করা।
- ৮। ১০ম গ্রেড বা তদোর্ধ পদের নিয়োগ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে দেওয়া।
- ৯. গ্রন্থাগারে কর্মরত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের পেশাদারিত্ত্বের সাথে গ্রন্থাগার পরিচালনা করা।
- ১০।পুস্তকক নির্বাচনের ক্ষেত্র গ্রন্থাগারের কর্মকর্তাদের মতামত নেয়া এবং ক্লার্ক ও বই সরবরাহকারীদের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত বয়কট করা।
- ১১। বিগত সময়ে সকল শিক্ষা কমিশনের গ্রন্থাগার সম্পর্কিত সুপারিশ সমুহ বাস্তবায়ন করা।
এস এম সাব্বির আকন্দ সহকারী লাইব্রেরিয়ান ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা