ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম
গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্রগ্রাম
গ্রন্থাগার হচ্ছে সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিবিম্ব। মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন ব্যবস্থা পাশাপাশি প্রচলন শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে বর্তমানকালে ব্যবস্থাপনা জ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রধান শাখা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। সাধারণভাবে কোনো কাজ সুন্দর ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে উপস্থাপন করার পদ্ধতিকে ব্যবস্থাপনা বলা হয়। ব্যবস্থাপনার ধারণাটি প্রাচীন। এক্ষেত্রে গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা এই দু’টি বিশ্লেষণাত্মক শব্দ ও বিষয় যার প্রায়োগিক, তাত্বিক ও তথ্যগত দিক দিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে যেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তেমনিভাবে এদের মধ্যে সূক্ষ্ম বৈসাদৃশ্যও লক্ষ্য করা যায়। Administration এর শাব্দিক অর্থ হলো শাসন, পরিচালনা, প্রয়োগ ও পরিচালক গোষ্ঠী। আর Management এর শাব্দিক অর্থ হলো পরিচালনা, শাসন, ব্যবস্থাপনা, পরিচালকবর্গ এবং শাসকবর্গ ইত্যাদি।
প্রাচীনকালে ব্যবস্থাপনার ধারণাটি জন-ব্যবস্থাপনাতে (Public Management) সীমাবদ্ধ মধ্যে ছিল। পরবর্তীকাল সমাজ কল্যাণের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রন্থাগারেও ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। পাঠক বা ব্যবহারকারীদের গ্রন্থাগার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, তাদের চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত সেবা প্রদান করা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে আধুনিক পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে সচেতন করা (যেমন-ইন্টারনেট ব্যবহার ও গ্রন্থাগার সফটওয়্যার সম্পর্কে মৌলিক ধারণা ইত্যাদি), যা একটি আধুনিক গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পরিচায়ক। আর এ আধুনিক গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হবে যোগ্য গ্রন্থাগার কর্মীদের। যা গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালনায় একটি পরিচায়ক। এ পর্যায়ে গ্রন্থাগার প্রশাসন এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নিন্মে আলোচনা করা হয়েছে।
গ্রন্থাগার কী ?
গ্রন্থাগারের ইংরেজি প্রতিশব্দ Library এর উৎপত্তি ঘটেছে মূলত ল্যাটিন শব্দ Liber থেকে। খরনবৎ শব্দটি থেকে Librarium শব্দটি এসেছে। যার অর্থ বই রাখার স্থান। এটি থেকে উদ্ভূত হয়েছে ফরাসি শব্দ Librarie এবং পরিশেষে ইংরেজি Library শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। UNESCO সংজ্ঞা মতে, ‘মুদ্রিত বই, সাময়িকী অথবা অন্য যে কোনো চিত্র সমৃদ্ধ বা শ্রবণ-দর্শন সামগ্রীর একটি সংগঠিত সংগ্রহ হলো গ্রন্থাগার।’ যেখানে পাঠকের তথ্য, গবেষণা, শিক্ষা অথবা বিনোদন চাহিদা মেটানোর কাজে বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহারকে সহজতর করার জন্য নিয়োজিত থাকে কিছু কর্মী। জে এইচ শেরা বলেন-
“Library is a product of cultural maturation. It came into being when societies ceased to be nomadic and became urbanized, and when graphic records became important to effective operation of organized human relationship”
গ্রন্থাগার সমাজে সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং সমাজে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম। গ্রন্থাগার হলো জ্ঞান ও তথ্য ভান্ডার। যা পাঠোপযোগী মুদ্রিত ও অমুদ্রিত সকল সংগ্রহ এবং দৃশ্য ও শ্রাব্য সকল সংগ্রহের সমষ্টি। এই সামগ্রিক সংগ্রহ মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির সৃজনশীল নিদর্শন, সামাজিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের কার্যকর মাধ্যম এবং জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্যমূলক প্রতিষ্ঠান। পুস্তক ও অন্যান্য সামগ্রী যদি অন্য কোন উদ্দেশ্যে সংগৃহিত হয় তাকে কিন্তু গ্রন্থাগার বলা যায় না, তা হবে সমাহার। গ্রন্থাগারের মূল উদ্দেশ্য হলো এর সুষ্ঠু ব্যবহার ও জ্ঞান চর্চা। এ পর্যায়ে প্রশাসন সম্পর্কে নিন্মে আলোচনা করা হয়েছে।
প্রশাসন কী ?
প্রশাসন হলো ব্যবস্থাপনার সেই কাজ যা কোনো উদ্যোগের লক্ষ্যকে কর্মে রুপান্তরিত করে। অন্যভাবে বলা যায় যে, পূর্ব নির্ধারিত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যবস্থাপনা, নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের সমম্বয়ে গঠিত কার্যক্রমকে প্রশাসন বলা হয়। প্রশাসন সম্পর্কে শিক্ষাবিদগণ বিভিন্ন মতামত উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্যে White Head বলেন “The art of administration is the direction, co-ordination and control of persons to achieve some purposes and objectives.” প্রশাসন যে লক্ষ্য ও নীতি নির্ধারণ করে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা রুপায়নের প্রচেষ্টা করছে।
গ্রন্থাগার প্রশাসন কী ?
গ্রন্থাগার প্রশাসন হলো গ্রন্থাগারগুলোর পরিকল্পনা, সংগঠিত, কর্মী নিয়োগ ও বিভিন্ন দিক নির্দেশনা এবং নিয়ন্ত্রণ করা। এক্ষেত্রে অন্যভাবে বলা যায় যে, গ্রন্থাগার প্রশাসন গ্রন্থাগারগুলির জন্য অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক প্রশাসনিক বিষয়গুলি পরিচালনা করে, ব্যবস্থাপক নেতৃত্ব, কৌশলগত পরিকল্পনা, সংস্থান ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন/তহবিল সংগ্রহ এবং বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপের দিক নির্দেশনা প্রদান করে। গ্রন্থাগার প্রশাসন সম্পর্কে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বিভিন্নভাবে মতামত দিয়েছেন। যা হলো- The library administration is an interface specific to each library. Library administrators can access it to configure library settings and manage daily activities in the library. গ্রন্থাগার প্রশাসন তার দৈনন্দিন কাজকমর্কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কার্যক্ষেত্রের সমস্যা ও সমাধান, নেতৃত্ব ও সমম্বয়, নির্দেশ ও ব্যবস্থাপনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি সার্বিক নিয়ন্ত্রণের কাজই হলো গ্রন্থাগার প্রশাসন। একটি গ্রন্থাগারের উন্নতি, অবনতি কিংবা সাফল্য, ব্যর্থতা অথবা কর্মোদ্যোগ ও কর্মহীনতা নির্ভর করে গ্রন্থাগার প্রশাসনর উপর।
ব্যবস্থাপনা কী ?
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সঙ্গতি রেখে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়েছে। বস্তুত মানুষ যখন থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে সমাজে বসবাসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তখন থেকেই ব্যবস্থাপনার সূত্রপাত ঘটেছে। সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডের জটিলতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। আধুনিক যান্ত্রিক ও প্রযুক্তি নির্ভর সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে এ ব্যবস্থাপক শ্রেণি। একটি দেশের আর্থ-সামাজিক ও শিল্পীর উন্ন্য়নে ব্যবস্থাপকগণ পালন করে এক মুখ্য ভূমিকা। কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সম্পাদিত কার্যক্রম পরিকল্পনা, সংগঠন, নেতৃত্বদান ও নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সমম্বয়ে আবির্ভূত বিষয়ই হচ্ছে ব্যবস্থাপনা। ব্যবস্থাপনা শব্দটি ব্যাপক অর্থবহ এবং বিভিন্ন মনীষী একে বিভিন্নভাবে ব্যাখা করেন। ইটালীয় শব্দ ম্যানেজিয়ার (Maneggiare) ও ম্যানেজ (Manage) থেকে ইংরেজি Management শব্দটির উৎপত্তি হয়; যার বাংলা অর্থ হচ্ছে ব্যবস্থাপনা।
Maneggiare শব্দের অর্থ হল অশ্বকে পরিচালনা করা। কিন্তু কালের বিবর্তনের অর্থেরও পরিবর্তন হয়। বর্তমানে এটি মূলত মানব জাতিকে পরিচালনা করার অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। Manage শব্দটির অর্থ হল কর্তৃত্ব করা। ব্যবস্থাপনা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হয়। বস্তত বর্তমানে ব্যবস্থাপনার অর্থই হচ্ছে, মানবীয় ও বস্তুগত সম্পদসমূহের কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করা। ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে J.N. Schulze –“Management is the force which leads, guides and directs an organisation in the accomplishment of a pre-determined object..” উপরি-উক্ত সংজ্ঞাসমূহের আলোকে বলা যায় যে, ব্যবস্থাপনা মূলত প্রতিষ্ঠানের এমন একটি অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যা বিভিন্ন কলা-কৌশল ও কার্যক্রমের মাধ্যমে এবং জনশক্তিসহ অন্যান্য উপাদানের সহায়তায় স্বল্পতম ব্যয়ে সর্বাধিক প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়। ব্যবস্থাপনা মুলত একটি দল বা প্রতিষ্ঠানের উপকরণাদির দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে পূর্ব নির্ধারিত উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্তে একটি কর্ম-প্রক্রিয়া বিশেষ। ব্যবস্থাপনার সাথে গ্রন্থাগারের সম্পর্কের কী বা গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা কী ? তা নিম্নে বর্ণিত হলো-
গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা কী ?
বাংলাদেশে গ্রন্থাগার ব্যবস্থার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, সেবার মান উন্নয়ন ও দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কর্তৃপক্ষ প্রশিক্ষণ উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে আসছে। উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পাঠ্যসামগ্রী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন, ওয়েবসাইট প্রর্বতন, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদান, পর্যাপ্ত কম্পিউটার ক্রয় ও প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার উন্নয়ন ইত্যাদি। সাধারণভাবে গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বলা যায়-Library management is a sub-discipline of institutional management that focuses on specific issues faced by libraries and library management professionals. মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই ব্যবস্থাপনার প্রচলন শুরু হয়েছিল। বিংশ শতকের ব্যবস্থাপনা হলো জ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রধান শাখা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্যবস্থাপনা সমাজের উন্নতি ও কল্যাণের সোপানরুপে কাজ করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেখা গেল যে উন্নত ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ফলে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জাপান, জার্মানী ও রাশিয়া ইত্যাদি দেশসমূহ প্রভুত উন্নতি লাভ করে। প্রশাসন যে লক্ষ্য ও নীতি নির্ধারণ করে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা রুপায়নের চেষ্টা করে। ফলে ব্যবস্থাপনা প্রশাসনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। গ্রন্থাগার সংগঠনের জন্য প্রশাসন যে নীতি নির্ধারণ করে, তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করাকেই গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বলে।
গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার মূলনীতি
গ্রন্থাগার সংগঠনের জন্য প্রশাসন যে নীতি নির্ধারণ করে, তা বাস্তবায়নের যে চেষ্টা তাকে গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বলা হয়। বিশেষ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ব্যতীত যেমন কোনো ব্যবস্থাপনাই সঠিক ব্যবস্থাপনা হতে পারে না। তেমনি ব্যবস্থাপনাকে সুচারুরুপে কার্যকরি করার জন্য সঠিক নীতি প্রণয়ন করা বাধ্যতামুলক। ব্যবস্থাপনার নীতিসমূহকে গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে। সত্যিকার অর্থে গ্রন্থাগারিকও একজন প্রশাসক। তাকে যেমন একদিকে ব্যবস্থাপনা শান্ত্রের তত্ত্বসমূহকে স্মরণ রাখতে হয়। অপরদিকে তেমনি জনপ্রশাসনের নীতিসমূহের দিকেও সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে হয়। গ্রন্থাগারিককে শুধু বিদ্বান হলেই চলে না, তাঁকে বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনার মূলনীতি সম্বন্ধেও হতে হয় যোদ্ধা। হেনরী ফেয়লকে আধুনিক ব্যবস্থাপনা নীতির জনক বলা হয়। তিনি ১৯১৬ সালে Industrial and general administration নামে একটি বই রচনা করেন। এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে গ্রন্থাাগর প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার নীতিগুলো সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে ব্যবস্থাপনার মূলনীতিসমূহের প্রায়োগিক দিক এবং বাংলাদেশের গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় সাংগঠনিক কাঠামো কী হওয়া উচিত। বাংলাদেশের গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সমস্যা ও তার সুপারিশমালার সম্ভাব্য পন্থা সম্পর্কেও আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। গ্রন্থাাগর প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার মূলনীতিগুলো সংক্ষিপ্ত পরিসরে নিন্মে বর্ণিত হলো-
ক. গ্রন্থাগারের কাজগুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং প্রতিটি কাজের জন্য প্রয়োজন অনুসারে কর্মকর্তা ও কর্মচারি নিয়োগ করতে হয়।
খ. ফেয়ল এর মতে কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব একই সাথে চলে। গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য একটি যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবং তাদের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে গ্রন্থাগার প্রধানসহ সবাই মিলিভাবে প্রশাসনিক নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে থাকেন। গ্রন্থাগার প্রধান অর্থাৎ গ্রন্থাগারিক প্রশাসনিক কার্যক্রমের সকল দায়িত্ব পালন করে থাকে। একজনের দায়িত্ব অন্যের উপর বর্তায় এবং আরও নিচ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তবে মূল নির্বাহী সকল ক্ষমতা কিন্তু তাঁর নিজের হাতেই রাখেন। যেমন-বিশ^বিদ্যালয় গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক তার ক্ষমতা উপ-গ্রন্থাগারিককে দিয়ে থাকেন। তাই কাজের সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য এ ব্যবস্থা নেয়া হয়।
গ. গ্রন্থাগার পরিচালনায় সাধারণত দু’ধরনের গ্রন্থাগার কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। এক. পেশাদারী (যাদের গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের ডিগ্রি আছে) দুই. অপেশাদার (যাদের গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের ডিগ্রি নেই)। তবে গ্রন্থাগারের অপেশাদার কর্মীদের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রশাসকদের উচিত কর্মী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ডসহ কঠোর ভূমিকা পালন করা। এক্ষেত্রে সঠিকভাবে সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন না করার কারণে বিভিন্ন গ্রন্থাগারের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে।
ঘ. গ্রন্থাগারে একাধিক বিভাগ থাকে এবং প্রত্যেকটি কাজের জন্য একই কর্তৃপক্ষ থাকে। ফেয়লের মতে একটি প্রতিষ্ঠানের একজন ব্যবস্থাপক এবং সকল কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত। যার দৃষ্টিভঙ্গি হবে একই উদ্দেশ্য সংবলিত।
ঙ. গ্রন্থাগার একটি সেবামূলক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এখানে একজন গ্রন্থাগার কর্মীর নিজস্ব স্বার্থের চেয়ে পাঠকদের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থ যদিও ব্যাঘাত ঘটে তবুও তা মেনে নিয়ে পাঠককে সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। তাই একজন গ্রন্থাগার কর্মী অথবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ সবারই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত গ্রন্থাগারের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন করা।
চ. গ্রন্থাগার কর্মীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা ইত্যাদি সবকিছু বিবেচনা করে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা উচিত। এতে কাজের প্রতি কর্মচারিদের আগ্রহ বুদ্ধি পায়। বিশেষ করে আমাদের দেশে গ্রন্থাগারিক ও গ্রন্থাগারে নিয়োজিত কর্মীগণ যোগ্যতা অনুসারে সম্মানি বা বেতন পায় না। ফলে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের প্রতি মনোযোগ বেশি থাকে না।
ছ. একটি গ্রন্থাগারের বিভিন্ন বিভাগ বা শাখা রয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসনিক শাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। বাংলাদেশে তথা বিশ্বে বিভিন্ন প্রকার বা ধরনের গ্রন্থাগার রয়েছে। গ্রন্থাগারের ধরণ অনুযায়ী কাজের পরিধিও ভিন্ন ধরনের হয়। যেমন-গণগ্রন্থাগার, জাতীয় গ্রন্থাগার ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার রয়েছে। গ্রন্থাগারের পাঠ্যসামগ্রীর সংগ্রহ, পরিমাণ, পাঠক ও তাদের উদ্দেশ্যেও উপর ভিত্তি করে পাঠ্যসামগ্রীর প্রস্তুতিকরণ, বাঁধাই এবং ফটোকপি শাখাসমূহের কাজ ভিন্ন হওয়া উচিত। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের পুস্তক নির্বাচন কাজটিও ভিন্নভাবে করা উচিত। এর জন্য গ্রন্থাগারিককের বিশেষ বাস্তব দক্ষতার প্রয়োজন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিকদের চেয়ে বিভাগীয় বা সেমিনার গ্রন্থাগারিকগণ তাদের বিষয়ের বিশেষায়ণ সম্বন্ধে অধিক অবগত থাকে। কিন্তু অর্ডার ইস্যু কাজটি কেন্দ্রীয়ভাবেই করা উচিত। যাতে গ্রন্থপঞ্জিগত উপাদান, গ্রন্থাগার সামগ্রী এবং বইগুলো ডুপ্লিকেশন না হয়।
জ. গ্রন্থাগারের কাজের সুবিধার্থে প্রত্যেক কর্মীর জন্য কাজ এবং কাজের জন্য কর্মী নির্ধারণের নীতি বাস্তবায়িত করতে হবে। যেমন-একজন ব্যক্তি যে বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে তাকে সে কাজে নিয়োগ প্রদান করা উচিত। তবে গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রে একজন শ্রেণিকরণবিদকে রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগে নিয়োগ করা যথার্থ সিদ্ধান্ত হবে না। তাই প্রত্যেক ব্যক্তির কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে।
ঝ. একটি গ্রন্থাগারের কার্যক্রমের সাফল্য নির্ভর করে সমম্বয় সাধনের উপর। সমম্বয় সাধন অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একটি গ্রন্থাগারের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কাজের মধ্যে সমম্বয় না থাকে তাহলে গ্রন্থাগারটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা অসম্ভব। এতে গ্রন্থাগারের কার্যক্রমে বিশৃংখলা দেখা দেয়। আরও বলা যায় যে, সাময়িকী শাখা এবং তথ্যায়ন শাখার মধ্যে সমম্বয় না থাকলে সমস্যার সৃষ্টি হবে। এটাই স্বাভাবিক। তাই কোনো গ্রন্থাগার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমম্বয় সাধন অপরিহার্য।
ঞ. গ্রন্থাগার বিজ্ঞানীদের মতে কর্তকর্তা ও কর্মচারিদের দায়বদ্ধতা গ্রন্থাগারের জন্য অতীব জরুরি। গ্রন্থাগার সুচারুরুপে পরিচালনার জন্য কর্মকর্তাদের সংখ্যা, গুণাগুন এবং কর্মদক্ষতা পরিমাপের উপর বিশেষ জোর দিতে হবে। এখানে বলা যায় যে, কর্মচারির কর্ম দক্ষতার পরিমাণ তার দায়বদ্ধতা উপর ভিত্তি করা উচিত। দায়বদ্ধতা বলতে আমরা বুঝি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারি নিজেকে কতটুকু দায়বদ্ধ ভেবে তার দায়িত্ব পালন করে। গ্রন্থাগারে রেফারেন্স বিভাগে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নিন্মলিখিত মানদণ্ড অনুসরণ করা যেতে পারে। পাঠক বা ব্যবহারকারীদের শতকরা ৭৫% প্রশ্নের উত্তর দিলে রেফারেন্স গ্রন্থাগারিক তাদেরকে সম্পূর্ণ সন্তুুষ্টির রাখা সম্ভব। এতে পাঠক বা ব্যবহারকারীগণ রেফারেন্স বিভাগের প্রতি আকৃষ্ট হবেন।
উপরি উক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কোনো গ্রন্থাগার কর্মী যদি কোনো মহতী উদ্যোগ নেন তাহলে তাকে অবশ্যই সাধুবাদ ও উৎসাহিত করা উচিত। সেই সাথে গ্রন্থাগারিক নিজেও গ্রন্থাগার সেবার মানোন্নয়নে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া যদিও কোনো গ্রন্থাগার কর্মী দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন তাহলে তাকে বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা উচিত। তবে পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকলে কাজের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে উন্নত হবে সেবার মান এবং গ্রন্থাগার পৌছাতে পারবে সফলতার দ্বার প্রান্তে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নিন্মে আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। যার আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮২ লক্ষ। জনসংখ্যার বৃদ্ধি হার ১ দশমিক ৩০ শতাংশ। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যার বৃহৎ একটি অংশ ৭৮.৬% গ্রামে ২১.৮% শহরে বসবাস করে। প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ১০১৫ জন লোক বাস করে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মানব সম্পদ উন্নয়ন একটি অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাত। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ১৯৯১ সালে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে শিক্ষার হার ৭৫.৬ শতাংশ। এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা ও গ্রন্থাগারগুলোর বর্তমান অবস্থা উন্নত বিশ্বের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। অথচ দেশের উন্নয়ন ও গবেষণার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য উন্নতমানের দক্ষতাসম্পন্ন প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রন্থাগারগুলোতে অপরিহার্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গ্রন্থাগারগুলোর ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন ব্যবস্থা অনেকাংশেই দুর্বল। অনেক সময় গ্রন্থাগারিক বা পরিচালক তার নিজস্ব মতানুসারে গ্রন্থাগার পরিচালনা করতে পারে না। বিভিন্ন প্রকার গ্রন্থাগারের প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার বর্তমান অবস্থা আলোচনা করলেই দেশের গ্রন্থাগার অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৫টি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ৫টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (সুত্র-ইউজিসির ওয়েবসাইট), ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ৬টি মিলিটারি মেডিকেল কলেজ, ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এবং ৩৩০৯টি কলেজের মধ্যে সরকারি কলেজ ৬০৭টি এবং বাকী বেসরকারি কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি কলেজ রয়েছে। আর ১৩৯২টি (সূত্র-ইন্টারনেট) সরকারি ও বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়েও আরও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর নিয়মনীতির আলোকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলোর পরিচালিত হয়।
বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে কিছু গ্রন্থাগার আছে। যার সেবার মান অনেকাংশে উন্নত। আর বাকী সরকারি (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারগুলোর সেবার মান আশাব্যঞ্জক নয়। কারণ সেবার মান আশানুস্বরুপ উন্নত হয়নি। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক দিয়ে গ্রন্থাগারগুলো পরিচালিত করা হচ্ছে। এতে প্রশাসনিক কার্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কারণ যিনি গ্রন্থাগারের দায়িত্বে থাকেন, তাকে গ্রন্থাগারের বাইরেও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সময় দিতে হয়। অর্থাৎ ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিকগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তাদেরকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক হিসেবে নিয়োগ প্রদান থাকেন। তাই কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার হলো ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃৎপিণ্ডস্বরুপ। হৃৎপিণ্ড ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচতে পারে না। তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার সঠিকভাবে পরিচালনা ছাড়া ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও গবেষকদের সঠিকভাবে জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। ফলে গ্রন্থাগারটি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অর্থাৎ তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন (পিএইচডি) গ্রন্থাগারিক প্রয়োজন। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারগুলোর অবস্থা আশানুস্বরুপ নয়। কারণ কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিন্ম পদের কর্মচারি অথবা গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ডিগ্রি ধারীদের দ্বারা গ্রন্থাগার পরিচালনা করছে। যা উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বাঁধাস্বরুপ।
বেসরকারি কলেজ গ্রন্থাগারগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অনেক কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ার উপযোগী পাঠকক্ষের ব্যবস্থা নেই। আবার অনেক কলেজে গ্রন্থাগারে ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় পাঠোপকরণ খুবই কম এবং গ্রন্থাগারে পাঠের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও নেই। কলেজ গ্রন্থাগারগুলো কলেজ পরিচালনা পর্যদ এবং কলেজ অধ্যক্ষই পরিচালনা করে থাকেন। তবে এখানে বলে রাখা ভালো কলেজের গ্রন্থাগারিকের ভূমিকা গৌণ। অনেক কলেজে দেখা যায় গ্রন্থাগারিক নেই। আর সাধারণ ডিগ্রিধারী লোক দিয়ে গ্রন্থাগার পরিচালনা করা হয়। যার জন্য কলেজ গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মানসম্মত গ্রন্থাগার থাকলেও সেবার মান তুলনামুলক আশানুস্বরুপ নয়। এদিকে সরকারি কলেজ গ্রন্থাগার আছে এবং গ্রন্থাগারিকও আছে। ব্যবহারকারী খুবই সীমিত। এছাড়াও কোনো কোনো কলেজ গ্রন্থাগারে বইপত্র ও ব্যবহারকারী উভয় আছে। কিন্তু সেবার মান তুলনামুলক হতাশাব্যঞ্জক।
বিশেষ গ্রন্থাগারগুলোর প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা অন্যান্য গ্রন্থাগারের তুলনায় কিছুটা ভালো। অনেক সময় দেখা যায় যে, প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়তো গ্রন্থাগারিকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রন্থাগার পরিচালনার উৎসাহ বোধ করেন না। তাই একটি বিশেষ গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিকের মতানুসারে বলতে হয় যে, বাংলাদেশে বিজ্ঞানী ও গবেষকবৃন্দ বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য উন্নত মানের গ্রন্থাগারের সাহায্যেই নিয়ে থাকেন। এ কথাটি তারা অপকটে স্বীকার করেন। কিন্তু আমাদের দেশের গ্রন্থাগারেও যে উন্নত দেশের মতো হওয়া উচিত। এ সত্যটি বাস্তবায়নে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। যার জন্য অনেক বিশেষ গ্রন্থাগারিকের মনে ক্ষোভ থাকে এবং অনেকেই পদমর্যাদাার দিক দিয়ে মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। এখানেও গ্রন্থাগারিকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা উচিত।
বাংলাদেশের গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সমস্যা
অতীতে একটি গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগার সামগ্রী, জনবল এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যা সীমিত ছিল। সে সময় যেমন লোকবল কম ছিলো তেমনি গ্রন্থাগার প্রশাসনের দায়-দায়িত্ব তুলনামূলক কম ছিল। আজকের যুগে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর। তাই পাঠকদের অতিদ্রূত সেবা প্রদানের জন্য গ্রন্থাগারে প্রযুক্তির ব্যবহার অতি জরুরি। ফলে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তত্ত্ব ও তথ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু প্রশাসনিক দুর্বলতা ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বল কাঠামোর কারণে সেবার মান উন্নত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাংলাদেশে গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার নিন্মলিখিত সম্যস্যাসমূহ বর্ণিত হলো-
১.অর্থনৈতিক কারণে গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে। অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় উপকরণ (যেমন বইপত্র ও অন্যান্য উপাদান) সময়মতো ক্রয় করা যায় না। তাই সেবার মান উন্নত হয় না।
২.গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার নীতিসমূহের সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। এতে করে গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বিভিন্নমুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়।
৩. গ্রন্থাগার প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জনবলের অভাব।
৪. গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত উচ্চতার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের অভাব।
৫. বেতন বৈষম্য ও নিন্ম বেতন কাঠামোর কারণে গ্রন্থাগার কর্মীদের মধ্যে দায়িত্বের প্রতি অনীহা।
৬. প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের অভাব।
৭. উপযুক্ত গ্রন্থাগার নীতিমালার অভাব।
গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সমাধান
গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হলে তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রাপ্ত (পিএইচডি) গ্রন্থাগারিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া জরুরি। এতে গ্রন্থাগার সেবার মান উন্নত হবে। আমাদের দেশের গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সুপারিশমালা নিন্মে বর্ণিত হলো-
১. গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং পেশাগত দক্ষতা সম্পন্ন জনবল সৃষ্টির জন্যই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান অতীব জরুরি।
২. গ্রন্থাগারগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য উন্নত দেশের আলোকে গ্রন্থাগার নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
৩. গ্রন্থাগার ও তথ্যসেবায় উৎকর্ষ বৃদ্ধি করার জন্য তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আধুনিক বিশ্বের সারিতে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের সেবার মান, তথ্য বিতরণ ব্যবস্থায় সাফল্য এবং তথ্য প্রাপ্তির নিশ্চিয়তা বিধানের জন্য তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
৪.বর্তমান বিরাজমান বেতন বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করে একটি অভিন্ন বেতন কাঠামো প্রণয়ন করার বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. গ্রন্থাগারসমূহের অর্থনৈতিক সমস্যা উত্তরণ ও উন্নয়নের জন্য সরকার, শিল্পপতি এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
পরিশেষে বলা যায যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা আমাদের সমাজের উন্নতি ও কল্যাণের সোপানরুপে কাজ করছে এবং উন্নত প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ফলে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জাপান ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো প্রভূত উন্নতি লাভ করছে। সে সাথে গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাও বাংলাদেশে কালের আর্বতে উন্নতি লাভ করছে গতানুগতি। কিন্তু সবক্ষেত্রে এর ছোঁয়া পড়েনি। তবে আমাদের দেশে আস্তে আস্তে এর প্রসার ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা দিন দিন উন্নত হচ্ছে। সেবার মান উন্নত হচ্ছে। বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে এবং তথ্য প্রযুক্তির দিক থেকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের হাতে এখন বিশ্ব। এর ফলশ্রুতিতে গ্রন্থাগার প্রশাসন ও তথ্যকেন্দ্রের পরিপূর্ণ উন্নতি সাধন হবে এবং যার ফলে পাঠক, গবেষক ও সুশীল সমাজ এর সুফল ভোগ করতে পারবে। এতে করে দেশ ও জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে।
তথ্যসূত্র
- Shera, J.H. (1972), the Foundations of Education for Librarianship, New York. Becker and Hayes
- খান ,ড. আবদুল আউয়াল ও ড. মোহাম্মদ আবু তাহের (২০০৮), ব্যবস্থাপনা, ঢাকা: আবীর পাবলিকেশন
- Kumar, Krishan (1989), Library Administration & Management, New Delhi: Vikas Publishing House, 3rd edition
- Sharma, C.K (1985), Library Management & Organization, New Delhi: Shee Publishing House
- আহাম্মদ,এ.ডি.এম. আলী (২০১১), স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ও অন্যান্য গ্রন্থাগার পরিচালনা, ঢাকা: প্রকাশন
- Henri Fayol, (2015), Industrial and general administration, Pickering & Chatto
- নজরুল ইসলাম, মোঃ (২০১২), গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা, ঢাকা: শাপলা প্রকাশনী
- আহাম্মদ,এ.ডি.এম. আলী (২০০৯),গ্রন্থাগার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা, ঢাকা: নবরাগ প্রকাশনী
- দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা, ২৮ জুন ২০২১
- রফিকুল ইসলাম, ড. মোঃ (২০১৯), ঢাকার গ্রন্থাগারের ক্রমবিকাশ ও ব্যবস্থাপনা, ঢাকা: সময় প্রকাশন
- ইউজিসির ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহ
- ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহ