“মার্ক্সবাদ (Marxism)” ব্যতীত সমাজবিজ্ঞান, “তাপগতিবিদ্যার প্রথম সুত্র (First Law of Thermodynamics)” ব্যতীত পদার্থবিজ্ঞান কিংবা “লা’হসপিটাল রুল (L’hospital Rule)” ব্যতীত গণিত যেমন অসম্পূর্ণ তেমনি “পঞ্চনীতি” ব্যতীত গ্রন্থাগার বিজ্ঞান অসম্পূর্ণ। গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের এই “পঞ্চনীতি”র জনক হলেন ড. এস. আর. রঙ্গনাথন।
১৮৯২ সালে আগস্ট মাসে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের তামিলনাড়ুর তাঞ্জোভুর জেলার অন্তর্গত শিয়ালীতে জন্মগ্রহন করেন গ্রন্থাগার বিজ্ঞানী ড. শিয়ালী রামামৃতা রঙ্গনাথন। অনেকের মতে তাঁর জন্মদিন ১২ আগস্ট হলেও তিনি স্ব লিখিত গ্রন্থে ৯ আগস্ট দিনটিকেই জন্মদিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
শিয়ালীর স্থানীয় হিন্দু হাই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন শিশু ড. রঙ্গনাথন। পরবর্তীতে মাদ্রাজ ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে গণিতে স্নাতক এবং ১৯১৬ সালে গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। শিশুকাল থেকেই এই গ্রন্থাগার বিজ্ঞানী একজন শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। শৈশবের লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার প্রথম ধাপ হিসেবে তিনি ১৯১৭ সালে মাদ্রাজের টিচার্স কলেজ থেকে লাইসেন্সিয়েট ইন টিচিং বা এল.টি অর্জন করেন। ১৯২১ মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন রঙ্গনাথন।
১৯২৩ সালের কথা, মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিক পদটি খালি হয়। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহের বই ও নথিপত্র রক্ষণাবেক্ষণ ও গ্রন্থাগারের মানোন্নয়নের দায়িত্ব ছিল গ্রন্থাগারিকের উপর ন্যাস্ত। ১৯২৪ সালে উক্ত পদে যোগ দিয়ে ড. রঙ্গনাথনের নতুন কর্মজীবন শুরু হয়। গ্রন্থাগারিক পদে নয়শো জন আবেদনকারীর মধ্যে তেমন কেউই গ্রন্থাগারিকতা পেশার দায়িত্ব পালনের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন না। কিন্তু ড. রঙ্গনাথনের গবেষণার নথিপত্র দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির তাকেই নির্বাচন করলে তিনি এই পদে কাজের সুযোগ পান।
গ্রন্থাগারের বই বিন্যাসকরণ এর ক্ষেত্রে ড. রঙ্গনাথন তাঁর গণিতের প্রতিভাকে কাজে লাগান। সেকালে জনপ্রিয় ডেসিমেল ক্লাসিফিকেশনের ত্রুটিগুলি অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করেন এবং এই পদ্ধতির আরো নানা সম্ভাবনার দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করেন। গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ড. রঙ্গনাথন ‘অ্যাকনলেজমেন্ট অফ ডুপ্লিকেশন’ তত্ত্ব তৈরি করেন, যে তত্ত্ব অনুযায়ী তথ্য বিন্যাসের যে কোনো পদ্ধতিতেই প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ন্যূনতম দুটি পৃথক বিন্যাস থাকা আবশ্যক। তিনি ঘটনাচক্রে এই পুরো তত্ত্বটি ডিউই ডেসিমেল ক্লাসিফিকেশনের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন।
তথ্য-পুনরুদ্ধার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর আবিষ্কৃত পন্থা খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয় এবং সব গ্রন্থাগারে গ্রহনযোগ্যতা পেতে থাকে। ইংল্যাণ্ডে তিনি গবেষণার কাজে যান, সেখানে থাকাকালীন সময়ে তিনি এই তত্ত্বগুলোকে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। যা পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে ‘কোলোন ক্লাসিফিকেশন’ নামে পরিচিত হয়। গবেষণা শেষে তিনি নিজ দেশে ফিরে আসেন।
ড. রঙ্গনাথন প্রায় ২০ বছর মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিকতার দায়িত্ব পালন করেন। এই দীর্ঘ ২০ বছর কর্মজীবনে তিনি একটি উন্নত গ্রন্থাগারের প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করেন এবং মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে প্রয়োগ করেন। তার তৈরি নীতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –
- সকাল আটটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত গ্রন্থাগার খোলা রাখা।
- গ্রন্থাগারের মধ্যে উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা।
- প্রয়োজনে বই বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
- বিশেষ সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী বইয়ের সম্ভারকে বিন্যস্ত করা।
গ্রন্থাগারে আগত গবেষক-পাঠকদের সহায়তা করার জন্য তিনি নতুন একটি পদ চালু করেন যার নাম ‘পিএআরএস’ অর্থাৎ পার্সোনালাইজড অ্যাসিসট্যান্স টু রিসার্চ স্কলারস। তিনি ১৯৩১ সালে ‘গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের পঞ্চ আইন’ তত্ত্ব প্রণয়ন করেন। এই তত্ত্বকে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটি আধুনিক, সুষ্ঠু ও গ্রাহকবান্ধব গ্রন্থাগার তৈরিতে ড. রঙ্গনাথনের পঞ্চনীতির কোন বিকল্প নেই। গ্রন্থাগারিক, গ্রন্থাগারের কর্মী, পাঠক ও অন্যান্য গ্রন্থাগার ব্যবহারকারীদের জন্য এই নীতি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
ড. রঙ্গনাথন তার পঞ্চনীতিতে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়েছেন –

- সব বই ব্যবহারের জন্য।
- প্রত্যেক পাঠকের জন্যই বই রয়েছে।
- প্রত্যেক বইয়েরই পাঠক রয়েছে।
- পাঠকের সময় বাঁচানো অবশ্যকর্তব্য।
- সর্বোপরি গ্রন্থাগার একটি বর্ধনশীল সংস্থা।
সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি গ্রন্থাগারকে সর্বজনীনভাবে ব্যবহারযোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা সহ পৃথিবীর অনেক দেশে ড. রঙ্গনাথনের এই তত্ত্বগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কর্মজীবনে ড. রঙ্গনাথন ছিলেন একজন দক্ষ, সফল ও গুণী ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন কর্মস্থলে তিনি কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহন করে ১৯৪৫ সালে ড. রঙ্গনাথন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৪৪ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। এরপর ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
তিনি অধ্যাপনা ও গ্রন্থাগারিকতা পেশার পাশাপাশি লেখক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘দ্য ফাইভ ল’স অফ লাইব্রেরি সায়েন্স’, ‘ক্লাসিফায়েড ক্যাটালগ কোড’, ‘লাইব্রেরি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’, ‘প্রলেগোমেনা টু লাইব্রেরি ক্লাসিফিকেশন’ ইত্যাদি। ১৯৭২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হয়ে এই গুণীজন মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পরে রঙ্গনাথনের একটি আত্মজীবনী প্রকাশ পায় ১৯৯২ সালে যার নাম ‘এ লাইব্রেরিয়ান লুকস ব্যাক’।
গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার রঙ্গনাথনকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে সম্মানিত করে এবং পরে ১৯৬৫ সালে ভারতের ‘ন্যাশনাল রিসার্চ প্রফেসর’-এর সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাঁর নামে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এছাড়াও তাঁর জন্মদিনটি ভারতে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। সারা বিশ্বের গ্রন্থাগারিকদের কাছে ড. রঙ্গনাথন একজন আদর্শ। গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে তাঁর অবদানের জন্য সকলের কাছে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অনেক চড়াই-উৎরাই পার করেছেন। ১৯০৭ সালে পনেরো বছর বয়সে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রুকমিনি নামের একজন নারীর সাথে, বিয়ের কিছুদিনের মাথায় মিসেস রুকমিনি একটি দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে সারদা নামের এক নারীর সাথে পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির ঘরে এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। ড. রঙ্গনাথনের দ্বিতীয় স্ত্রী মিসেস সারদা সব সময় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন, পাশে থেকেছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
তথ্যসূত্র:
১. wikipedia
২. A Librarian Looks Back by Dr. S.R. Ranganathan
আনিকা তাবাচ্ছুম গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিভাগ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, লালমাটিয়া, ঢাকা।