ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম
মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থাগার বিকাশ লাভ করেছে। সপ্তম শতাব্দীতে গান্ধার তক্ষশীলা ও কাশ্মীর প্রভৃতি স্থানের বৌদ্ধ বিহারে সুপরিচালিত গ্রন্থাগার ছিল। সেই সময়ে বিহার ও মন্দিরে গ্রন্থাগার ছিল এবং ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারও ছিল অসংখ্য। সুমেরিয়নরা আনুমানিক ২৭০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে মন্দির ও রাজপ্রসাদ বা ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। বোরিসপার গ্রন্থাগার ব্যাবিলনিয় সভ্যতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মাটির ফলকগুলি নকল করে আসীরিয় আসুরবনিপাল তাঁর নিনভের গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ করেছিলেন।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণায় বিশ্বের প্রথম গ্রন্থাগারের পরিচয় পাওয়া যায়। যা প্রাচীন ব্যাবিলনিয়ায় সেমিটিক সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠাতা প্রথম সারগনের রাজধানী আক্কাদে। আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব সপ্তদশ শতকে এই গ্রন্থাগারটি স্থাপিত হয়েছিল। ব্যাবিলনিয়ার মারি রাজ্যের রাজধানীর প্রাসাদের গ্রন্থাগারে কুড়ি হাজারেরও বেশি পোড়া মাটির ফলক পাওয়া যায়। তবে প্রাচীন মেসোপোটেমিয়া ও ব্যাবিলনিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে বহুসংখ্যক রাজ্য সংগঠিত গ্রন্থাগারের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিশ্বের প্রথম গ্রন্থাগারিকের যে পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি খৃষ্টপূর্ব সপ্তদশ শতকে জীবিত ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। খৃষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে ব্যাবিলনিয় সাম্রাজ্যের পতন হওয়া পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার বছর মেসোপোটেমিয়া ও ব্যাবিলনিয় রাজ্যগুলিতে গ্রন্থাগারের প্রভুত উন্নতি হয়েছিল। খৃষ্টপূর্ব সপ্তম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিক সম্রাটদের বিশাল গ্রন্থাগার ছিল। খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ইউরিপিডিস ও অন্যান্য পন্ডিতদের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে নানা বিষয়ে সমৃদ্ধ ছিল। এ্যারিস্টটলের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের সংগ্রহ ছিল যেমন বিপুল তেমনি বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাঁর গ্রন্থাগারে মানব জ্ঞানের সবগুলো শাখার উপর রচিত গ্রন্থ ছিল।
হেলেনীয় যুগে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া ও এশিয়া মাইনরের পারগমাম প্রভৃতি নগরে গ্রন্থাগার ছিল। আলেকজান্দ্রিয়াতে প্রথম টলেমী (খৃষ্টপূর্ব ৩০৫-২৮৩) পন্ডিতদের জন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে টলেমীরা সেই গ্রন্থাগারকে আরও সমৃদ্ধশালী করেছিলেন। এই গ্রন্থাগারে দু’লক্ষের ও অধিক গ্রন্থ ছিল। খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে এর গ্রন্থ সংখ্যা ছিল সাত লক্ষেরও বেশি এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় দ্বিতীয় গ্রন্থাগার সেরাপিয়াসে ছিল এক লক্ষেরও অধিক গ্রন্থ বা বই। গ্রন্থাগারগুলির সম্পদসমূহ ছিল সুবিন্যস্ত। আলেকজান্দ্রিয়া ও পারগমামের গ্রন্থাগারগুলি কয়েকশত বছর ধরে ধারাবাহিক সংগ্রহে পুষ্ট হয়েছে। পাঠকের ব্যবহারোপযোগী গ্রন্থ তালিকা প্রণয়ন করেছে। গ্রন্থ সম্পাদনা করে জ্ঞান চর্চার সহায়তা করেছে এবং অধিক সংখ্যক গ্রন্থাগার স্থাপন করে জ্ঞানের আলো বিকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গ্রিক সংস্কৃতির দ্বারা রোমকরা প্রভাবিত হয়। রোমান অভিজাত ও সেনাধ্যক্ষের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ছিল। ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার সামাজিক প্রতিষ্ঠার অন্যতম সোপান বলে পরিগণিত। সিসেরার (খৃষ্টপূর্ব ১০৬-৪৩) একাধিক ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সর্বত্র মূল্যবান গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছিল। জুলিয়াস সীজার সাধারণ গ্রন্থাগারের চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার প্রজাদের মধ্যে গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের ব্যাপক প্রচলন হোক। সকলেই শিক্ষিত হোক ও গ্রন্থ পাঠে উদ্বুদ্ধ হোক। গ্রন্থপাঠ সাংস্কৃতিক চেতনা প্রসারে সহায়ক হোক। সেই উদ্দেশ্যে তিনি সবগুলি গ্রন্থাগারের দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে কেবল রোমেই পঁচিশটিরও বেশি সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে রোমান সাংস্কৃতিরও ব্যাপক আকারে প্রসার ঘটেছিল। আর ইতালী, গ্রীস, এশিয়া মাইনর ও উত্তর আফ্রিকা প্রভৃতি রোমান সংস্কৃতির দ্বারা পুষ্টি প্রাপ্ত হয়েছিল এবং গ্রন্থাগার প্রচারের দ্বারা সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল।
বাগদাদের স্বর্ণযুগে খলিফা হারুন-অর-রশিদের সময়ে আরবের ঐতিহাসিক ওমর-আল-ওয়াকিদির যে পরিমাণ বই ছিল তাতে একশো কুড়িটা উট বোঝাঁই হয়ে যেতো। ৮১৩ খৃষ্টাব্দে হারুন-অর-রশিদের পুত্র খলিফা আল-মামুন ‘জ্ঞান ভান্ডার নামে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে একে একে মাদ্রাসা স্থাপিত হতে থাকে। দ্বাদশ শতাব্দীতে সেখানে ছত্রিশটি গ্রন্থাগার ছিল। এর মধ্যে একটির বইয়ের সংখ্যা ছিল দশ হাজার। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সবই ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে মোঘল আক্রমণের ফলে ধবংস হয়ে যায়। এছাড়াও আরবি সাহিত্যের রেনেসাঁ রচনার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তবে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায় আরব জাতি ইউরোপীয়দের তুলনায় অগ্রগামী। আব্বাসী খেলাফতের (৭৫০-১২৫৮) শুরু হতে সকল খলিফারাই গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা ও বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করার আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যান। ফলে প্রাচীন নগরী বাগদাদ ও বসরায় বড় বড় গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। যা আরব ও মুসলিম জাতির ঐতিহ্য ও গৌরবের বিষয় ছিল। কিন্তু আব্বাসীয়দের পতনকালে হালাকুখানের নেতৃত্বে তাতাররা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও নদীতে নিক্ষেপ করে হাজার হাজার মূল্যবান গ্রন্থগুলো ধবংস করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে নেক্কারজনক ঘটনা। মিশরের প্রায় সকল মসজিদের সাথে ছোট বা বড় অসংখ্যক আধুনিক গ্রন্থাগার ছিল এবং সেগুলোতে কোরআন, হাদীস, ফিকহ ও ইতিহাস বিষয়ক অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থও ছিল। তাছাড়া অনেক মূল্যবান পান্ডুলিপিও সংরক্ষিত ছিল। তবে এ সকল প্রাচীন গ্রন্থাগারগুলোর সাথে আধুনিক পাঠাগারের তুলনা করলে সেগুলোকে সর্বোচ্চ গ্রন্থ সংরক্ষণাগার বলা যেতে পারে। আরবি ভাষা ও সাহিত্য সংরক্ষণে ইউরোপে অনেক বড় বড় গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। সেগুলো প্রাচীন আরবি ভাষা ও সাহিত্যের অনেক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ও পান্ডুলিপি যুগ যুগ ধরে সংরক্ষণ করে চলেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আধুনিক গ্রন্থাগারগুলো নিম্নরূপ:-
১. বার্লিন গ্রন্থাগার: জার্মানি ও যেখানে চৌদ্দ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। ত্রিশ হাজার মূল্যবান পান্ডুলিপি রয়েছে। যা অধিকাংশই আরবি ভাষায় রচিত ছিল।
২. বন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার: তিন লক্ষ একষট্রি হাজার ছয়শত তেষট্রি গ্রন্থ রয়েছে এবং এক হাজার নয়শত একান্নটি পান্ডুলিপি রয়েছে।
৩. “এস্কোরিয়াল গ্রন্থাগার” ম্পেন: এই গ্রন্থাগারে পঁয়ত্রিশ হাজার পুস্তক রয়েছে। এর মধ্যে চার হাজার ছয়শত আঠাশটি পান্ডুলিপি ছিল।
৪. “লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার” লাইডেন: এই গ্রন্থাগারে দুই লক্ষ পুস্তক রয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ছয়শত গ্রন্থ প্রাচ্য ভাষাসমূহে লিখিত এবং অধিকাংশই আরবি ভাষায় রচিত।
৫. লন্ডন গ্রন্থাগার: এটি মূলত বৃটিশ যাদুঘরের একটি গ্রন্থাগার। এখানে আশি হাজার গ্রন্থ রয়েছে। যার একটি বড় অংশ আরবি ভাষায় রচিত পান্ডুলিপি।
৬. “অক্সফোর্ড গ্রন্থাগার” অক্সফোর্ড: এই গ্রন্থাগারটি ১৫৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর গ্রন্থের সংখ্যা মোট সাত লক্ষ। এছাড়াও ৩৩ হাজার আরবি পান্ডুলিপিও সংরক্ষিত আছে।
প্রাচ্যের আরবি গ্রন্থাগার
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে আরব বিশ্ব পুনরায় আরবি ভাষা ও সাহিত্য সংরক্ষণের জন্য আধুনিক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে মিশর ও সিরিয়া অগ্রগামী। ইস্তাম্বুলে অনেক প্রাচীন গ্রন্থাগার রয়েছে। কারণ ইস্তাম্বুলকে ইসলামী বিশ্বের রাজধানী মনে করা হয়। ইস্তাম্বুলের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থাগারের নাম এবং প্রতিষ্ঠাকালসহ নিন্মে উপস্থাপন করা হলো:-
গ্রন্থাগারের নাম |
প্রতিষ্ঠাতার নাম |
প্রতিষ্ঠাকাল (হি.) |
গ্রন্থ সংখ্যা |
সালীম আগা গ্রন্থাগার | আলহাজ্জ সালীম আমিন | ৯৫৫ হি. | ১৩৮২ |
রুস্তম পাশা গ্রন্থাগার | শায়খ পাশা সদরুল আসবাক | ৯৫৮ হি. | ৫৬০ |
আতিফ আফিনদী গ্রন্থাগার | মুস্তাফা আতিফ | ১১০৪ হি. | ২৮৫৭ |
আয়া সুফিয়া গ্রন্থাগার | সুলতান মাহমুদ আউয়াল | ১১৫২ হি. | ৫৩০০ |
আল ফাতিহ গ্রন্থাগার | সুলতান মাহমুদ আউয়াল | ১১৫৫ হি. | ৬৬১৪ |
ওলী উদ্দিন গ্রন্থাগার | শায়খ ওলী উদ্দীন | ১১৮২ হি. | ৩৪৮৪ |
আল উমুমিয়্যাহ গ্রন্থাগার | ওসমানী শাসকগণ | ১২৯৯ হি. | ৩৪৫০০ |
ইয়ালদায গ্রন্থাগার | সুলতান আব্দুল হামীদ | ১২৯৯ হি. | ২৬৭৬০ |
মাতহাফ গ্রন্থাগার | ওসমান শাসকগণ | ১৩০৬ হি. | ১৫২৬০ |
মিশরের গ্রন্থাগার
মিশরের বড় বড় গ্রন্থাগারগুলো কায়রোতে অবস্থিত ছিল। কোনো কোনো গ্রন্থাগার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। আর কোনো কোনো গ্রন্থাগার বিশেষ ব্যক্তিবর্গের জন্য নির্ধারিত। গ্রন্থাগারগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হল-
১. দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যা: মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার। আরবি সাহিত্যের পূনর্জাগরণের সময় সরকারিভাবে এ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন। মুহাম্মদ আলীর সময়ে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় এবং ইসমাঈল পাশার আমলে অর্থাৎ ১৮৭০ সালে এর কাজ সমাপ্তি ঘটে। আর সেখানে আশি হাজার বই সংরক্ষিত রয়েছে।
২.মাকতাবাতুন আযহারিয়্যা: অন্যান্য মসজিদের মত মিশরের আযহারেও প্রাচীন গ্রন্থাগার ছিল। প্রাচীনকালের শুরু দিকে বইয়ের সংখ্যা ছিল একশত নিরানব্বইটি এবং এগুলোই সবই বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল। পরবর্তীকালে ১৮৭৯ সালে সরকারি নির্দেশে এ গ্রন্থাগারটি আধুনিক গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত করা হয় এবং প্রয়োজনীয় গ্রন্থাদি সংগ্রহ করা হয়। যেখানে ছত্রিশ হাজার ছয়শত তেতাল্লিশটি গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে পান্ডুলিপির সংখ্যা ছিল দশ হাজার নয়শত বত্রিশটি।
৩. মাকতাবাতুল আরুকাহ ফিল আযহার: এটি আযহারের অপর একটি গ্রন্থাগার। যা ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেখানে ত্রিশ হাজার বই সংরক্ষিত রয়েছে।
৪ . মাকতাবাতুল মাসাজিদ ওয়া দারুল আছার: ১৯১৪ সালে এ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেখানে ত্রিশ হাজার পাঁচশত সাতষট্রিটি বই সংরক্ষিত রয়েছে।
৫. আল মাকতাবাতুল খেদীভিয়াহ: এটি মিশরে অবস্থিত এবং এটি একটি বিখ্যাত গ্রন্থাগার। যা মুহাম্মদ আলী পাশার শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাছাড়া মিশরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের জন্য অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। যেমন:-
ক. মাকতাবাতু কুল্লিায়াতিল হুকূক: ১৯১৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে উনিশ হাজার নয়শত পঞ্চাশটি বই সংরক্ষিত এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য স্বতন্ত্র হল রুমও ছিল।
খ. মাকতাবাতু কল্লিয়াতিত তিব: সেখানে চিকিৎসা ও পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ক ফরাসি, ইংরেজি ও আরবি ভাষায় প্রায় দশ হাজার কিতাব সংরক্ষিত রয়েছে। এ গ্রন্থাগারটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত ছিল।
গ. মাকতাবাতুল জামি’আতিল মিসরিয়্যা: ১৯১৪ সালে এ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে এগারো হাজার নয়শত ত্রিশটি গ্রন্থের সংগ্রহ রয়েছে। অধিকাংশ গ্রন্থগুলোর লেখক ও সাহিত্যিকদের উপহারস্বরূপ।
লিবিয়া ও লেবাননের গ্রন্থাগার
মিশর ও ইউরোপের ন্যায় সিরিয়া ও লেবাননের বেশ কিছু প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। আরবি সাহিত্যের পূনর্জাগরণে এসব গ্রন্থাগারের ভূমিকাও কোনো অংশে কম নয়। গ্রন্থাগারগুলো নিন্মরুপ-
ক. “আল মাকতাবাতুল যাহিরীয়্যাহ” দামেস্ক, ১৮৭৮
খ. “আল মাকতাবাতুল শারকিয়্যাহ” বৈরুত, ১৮৮০
গ. “মাকতাবাতুল জামি’আতি বৈরূপ আল আমরীকিয়্যাহ”
ঘ. “মাকতাবাতুল মাদরাসাহ আল আহমাদিয়্যাহ” আলেপ্পো, সিরিয়া
ঙ. “মাকতাবাতুল মাদরাসাহ আল রিদাইয়্যাহ” আলেপ্পো, সিরিয়া
চ. “আল মাকতাবাতুল মারুনিয়্যাহ” আলেপ্পো ও সিরিয়া ১৭২৫ সালে এ গ্রন্থাগারটি খ্রিস্টান মিশনারীরা প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রাচীন পারস্যে ব্যক্তিগত এবং অনেক সাধারণ গ্রন্থাগার ছিল। সেদেশে জ্ঞানচর্চার বিশেষ কদর ছিল। বোখারাতে চিকিৎসক-দার্শনিক আবু-আলি-ইবন সিনা (অর্থাৎ অবিচেন্না ৯৮০-১২১৭ খৃষ্টাব্দে) সুলতান ইবনে মনসুরের প্রাসাদ-গ্রন্থাগার সম্পর্কে বলেন, সেখানে একটা ঘরে আরবি ব্যাকরণ ও কবিতা এবং আরেকটা ঘরে আইনের বই এমনিভাবে প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা কামরা ছিল। পন্ডিত ইবনে আব্বাসের আমলে অর্থাৎ ৯৩৮-৯৯৫ খৃষ্টাব্দে চারশো উট বোঝাঁই পুঁথি ছিল। তা’র সূচি বা ক্যাটালগ ছিল দশ খন্ড। নিশাপুর ইস্পাহান, বসরা, সিরাজ ও মসুল প্রভৃতি প্রতিটি শহরে গ্রন্থাগার ছিল। ইংল্যান্ডের গ্রন্থ ইতিহাস বেশি পুরোনো নয়। ৬৭৮ খৃষ্টাব্দে রেনেভিষ্ট বিশপ রোম থেকে বই সংগ্রহ করে তাঁর জন্মস্থান নর্দ্দামব্রিয়াতে প্রতিষ্ঠিত ওয়্যার মাউথ মঠে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। ৬৭০-৭৩৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে সে দেশে অনেক গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। ৮৭৫ খৃষ্টাব্দে নিনেমার আক্রমণের ফলে বহু সংগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। তার মধ্যে বিখ্যাত ইয়র্ক ও ক্যান্টারব্যরি সংগ্রহও ছিল। দশম শতাব্দিতে উইনচেস্টার, উসেষ্টার ও ক্যান্টারব্যরি গ্রন্থাগার উল্লেখযোগ্য। ক্যান্টারব্যরি ক্রাইস্ট চার্চের যে গ্রন্থ তালিকা এষ্ট্রির প্রায়র হেনরি (১২৮৫-১৩৩১ খৃষ্টাব্দে) প্রস্তুত করেছিলেন তাতে তিন হাজার বই এর নাম পাওয়া যায়। মানব সভ্যতার প্রথম উষার আলো পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্য ও মিশরে। ভারতবর্ষে মানব সভ্যতার উন্মেষকাল মধ্যপ্রাচ্যের কালসীমার প্রায় সমসাময়িক। খৃষ্টপূর্ব তিন হাজার থেকে আড়াই হাজার বছর কালের মধ্যে ভারতে সিন্ধ সভ্যতার বিকাশ লাভ করে। ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার যে খুবই উন্নত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তখনকার জীবনযাত্রা ও বিভিন্ন ব্যবহার সামগ্রী আসবাবপত্র ও উন্নত সাংস্কৃতি জীবন ধারায়। হরপ্পা ও মহেনজোদারোর স্বচ্ছল নাগরিক জীবনযাত্রা ও আর্থিক সঙ্গতিপূর্ণ গ্রামীণ সমাজ কেবল সব্যতা নয় উন্নত সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয় বহন করে। সিন্ধু সভ্যাতার সাংকেতিক চিত্রলিপি সমসাময়িক কালে খুবই আধুনিক ও অর্থবহ ছিল। প্রায় তিন শতকের ও অধিক চিত্রলিপি সিন্ধু সভ্যতার কালে ব্যবহৃত ও হতো। সহজেই অনুমান করা যায় যে, এতগুলি চিত্রলিপি দিয়ে লিখিত উপাদান তখন ছিল এবং তা সংরক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ও প্রতিকুল প্রাকৃতিক পরিবেশের ফলে উত্তরণকালের জন্য রক্ষিত উপাদানগুলি বিলীন হয়ে যায়।
নালন্দার অধ্যাপকদের পান্ডিত্তের সুখ্যাতি ছিল। তাই সহস্র সহস্র বিদ্যার্থীর শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থার জন্য একটি বিরাট পুস্তক ভান্ডার নির্মাণ করে নালন্দা মহাবিহারের স্থাপয়িতা ও কর্ণধারগণ সংগঠনের দিক দিয়ে তাঁদের কর্ম কুশলতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন। চীনা পরিব্রাজকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এক সুবিশাল অঞ্চল গ্রন্থাগার ভবনের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। গ্রন্থাগার ভবনটি বহুতল বিশিষ্ট ছিল। এদের মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য ভবনের নাম যথাক্রমে রত্নদধি, রত্নসাগর ও রত্নরঞ্জক। রত্নদধি নয়তলা বিশিষ্ট ছিল। লামা তারানাথ ও অন্যান্য তিব্বতীয় পন্ডিতেরা সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে তাঁদের লেখার মধ্যে নালন্দার পুঁথি সংগ্রহের বিশালত্বের কথা উল্লেখ করেন। পরিব্রাজক উৎসিঙ এবং য়ুয়ান চোয়াঙ এই নালন্দা মহাবিহার হতে যথাক্রমে ৪০০ এবং ২০০ এর উপর মূলগ্রন্থের প্রতিলিপি প্রস্তুত করে নিয়ে যান। এ থেকে নালন্দা মহাবিহারের সংগ্রহের সংখ্যাধিক্যের কথা সহজেই অনুমান করা যায়। তের শতকে তুর্ক আক্রমনের ফলে নালন্দা মহাবিহার ধবংসপ্রাপ্ত হয়। মহাবিহার ধ্বংসের সাথে এর গ্রন্থাগারটিও অগ্নি দগ্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মহাস্থানগড় ও ময়নামতিতে বৌদ্ধ বিহার ছিল। সে সকল বৌদ্ধ বিহারগুলি আবাসিক ছিল এবং প্রত্যেকটিতে সুসংগঠিত সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী হলো গ্রন্থাগার আন্দোলনের স্বর্ণযুগ। তখন সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রন্থাগার অজস্র গড়ে উঠেছিল।
গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায় যে সকল দেশ অগ্রণী ভূমিকা ছিল তার মধ্যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালী, জার্মানী, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), কানাডা, আমেরিকা ও ভারতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুসলমান রাজত্বকালে লিখন শিল্পের উন্নতির অন্যতম কারণ ইসলাম ধর্মের সার্বজনীনতা। সমাজের কোনো স্তর বিশেষে শিক্ষা সীমাবদ্ধ না থাকাতে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে পুস্তক ব্যবহারে কোনো সামাজিক বাধা ছিল না। লিখন শিল্পের দ্রুত উন্নতির ফলে পুস্তক প্রণয়ন ও তার ব্যবহারও ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং মসজিদ, মাদ্রাসা ও মক্তবে কিছু কিছু পুস্তক সংগ্রহ গড়ে উঠে বলে জানা যায়। মুসলমান বাদশাহদের মধ্যে অনেকেই পুস্তকের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তোগলকের রাজস্বকালে রাজপ্রসাদে গ্রন্থাগার বা কিতাবশালা ছিল। ১৬৬২ খৃষ্টাব্দে দিল্লির রাজকীয় গ্রন্থাগারে ২৪০০০ পুস্তক বা পুঁথি ছিল। হুমায়ন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আলমগীর প্রভৃতি সকল মোগল বাদশাহই পুস্তকের অনুরাগী ছিলেন। হুমায়ন শেরশাহের ’সেরমণ্ডল’ নামক বিশাল প্রসাদটিকে রাজকীয় গ্রন্থাগারে রূপান্তর করেন। আকবরের রাজত্বকালে রাজকীয় গ্রন্থাগারের প্রভুত উন্নতি হয়। আকবরের রাজকীয় গ্রন্থাগারে ২৫০০০ বই ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল। টিপু সুলতানের সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থাগার ছিল। যা যুদ্ধের সময় লুষ্ঠিত হয়। শেষ র্পযন্ত এই সমৃদ্ধ সংগ্রহ বৃটেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বর্তমানে তা লন্ডন শহরে কমনওয়েলথ অফিসের ইন্ডিয়ান অফিস গ্রন্থাগারতে সংরক্ষিত রয়েছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান ও তথ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়া উন্নত হতে থাকে। দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় নানা ধরনের গ্রন্থাগার। বর্তমান যুগকে এক কথায় জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগ বলা যায়। মানুষ আজ পাতালপুরী থেকে আকাশে চড়ে বেড়াচ্ছে। মহাকাশ জয়ের নেশায় মত্ত। তাই মানুষ যতই উন্নতির শিখরে উঠছে, ততই গ্রন্থাগার নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তার সাধনা, গবেষণা ও অনুসন্ধান ক্রমেই গ্রন্থাগারমুখী হয়ে উঠছে। বিংশ শতাব্দীতে গ্রন্থাগারে বই ও পত্র-পত্রিকা সংরক্ষণের পাশাপাশি ফিল্ম, ফিল্মস্ট্রীপ, ম্যাগনেটিক টেপ, মাইক্রোফিস, মাইক্রোফিল্ম ও কম্পিউটার ইত্যাদি আধুনিক সামগ্রীতে সমৃদ্ধ ছিল। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তি যুগে গ্রন্থাগার সেবার মান উন্নয়নে জন্য বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থাগার সফটওয়্যার গ্রন্থাগারে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন- Library Software: KOHA and GREENSTONE, DSpace and RFID -Digital Library Software ও ইন্টারনেট। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের উন্নত মানের Software গ্রন্থাগারে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র
১. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সম্পাদিত, মুহাম্মদ সিদ্দিক খান রচনাবলী -১, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯৪
২. সুলতান উদদীন আহমাদ, আধুনিক গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান সিরিজ-৫: গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান স্বরুপ সন্ধানে, ঢাকা: প্রগতি প্রকাশনী, ২০০০
৩. জুরজী যায়দান, তারীখু আদাবিল লুগাহ আল আরাবিয়্যায়, বৈরূত: দারুল ফিকর, ২০০৫
৪. জুরজী যায়দান, তারীখু আদাবিল লুগাহ আল আরাবিয়্যায়, বৈরূত: দারুল ফিকর, ৪র্থ খন্ড, ২০০৫
৫. হান্না আল ফাখূরী, তারীখুল আদাবিল আরাবী, ‘বৈরূত: আল মাতবা’ আতুল বুলিসিয়্যায়, তা.বি.
ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্রগ্রাম