বইঃ লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি
ইসলামের হারানো ইতিহাস
মূলঃ ফিরাস আল খতিব
অনুবাদঃ আলী আহমাদ মাবরুর
বইয়ের ধরনঃ ইসলামিক ইতিহাস
প্রকাশনাঃ প্রচ্ছদ প্রকাশন
প্রচ্ছদঃ হাশেম আলী
International prize 10$
আধুনিক সময়ে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ মুসলিম ছেলে-মেয়ে তাদের শিকড় সম্পর্কে খুব বেশি অবগত নয়। স্কুল জীবনে ইসলাম শিক্ষা নামে একটি বিষয় পড়ানো হলেও মূল তথ্যগুলো তুলে ধরা হয় না। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বড় অংশ অজ্ঞ থেকে যায় এই বিষয়ে। লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি ( ইসলামের হারানো ইতিহাস) সহজ ভাষায় অনুদিত একটি ইতিহাসের বই। ইসলামের ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত প্রায় সব জনপদের ইতিহাসের সাথে পাঠকের একটি সামগ্রিক সংযোগ করিয়ে দেবার চেষ্টা আছে এই বইয়ে। লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সবারই পাঠ্য তালিকায় রাখার মত একটি বই। বইটি নবীন থেকে শুরু করে প্রবীণ সবাইকেই সাহায্য করবে তাদের শিকড়ের সন্ধান করতে। বইটি সম্পর্কে লিখার আগে চলুন এর লেখক সম্পর্কে ছোট্ট এক পরিচিতি জেনে আসি-
লেখক পরিচিতিঃ ফিরাস আল খতিব বইটির মূল লেখক। তাঁর জন্ম সিরিয়াতে। তিনি স্নাতকোত্তর করেছেন আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস বিষয় নিয়ে। বর্তমানে তিনি শিকাগোর দারুল কাসিমে শিক্ষকতায় কর্মরত আছেন। ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটি আন্তর্জাতিক বাজারে বেস্ট সেলারের তালিকায় জায়গা করে নেয়।
অনুবাদক পরিচিতিঃ আলী আহমাদ মাবরুর পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ইংরেজি সংবাদ বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এভাবেই একসময় লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। আর পেয়ে যান পাঠকপ্রিয়তা।
বই পরিচিতিঃ মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে লিখা লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রি বইটি। লেখকের মতে, ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে যারা বিশদভাবে জানতে চায় বইটি তাদের ততটা জানার কৌতুহল মেটাতে পারবে না। তবে যাদের অল্প কিছু জানা শোনা আছে, মূলত ইসলামিক ইতিহাসের শিক্ষার্থী নয় বইটি এমন পাঠককেই আনন্দিত করে তুলবে। ফিরাস আল খতিবের ক্লাস লেকচার সিরিজের সমন্বিত রূপ হলো হলো এই বই।
বইটিকে ১২ টি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়ই যেনো চুম্বকের মত আকর্ষণ ধরে রাখে। আরব জাতির উৎপত্তি এবং ইসলামপূর্বে আরবদের জীবন কেমন ছিল এটি দিয়েই বইটির সূচনা। ক্রমান্বয়ে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী, মুসলিমদের ৪ খলিফার জীবনী, জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলিমদের ভূমিকা, মোঙ্গল বাহিনী তথা চেঙ্গিস খান বাহিনীদের রাজ্য জয় করা, পশ্চিম-পূর্ব আফ্রিকা থেকে শুরু করে চীন,ভারত এবং এশিয়ায় মুসলিমদের জয়সহ আরো অনেক থ্রিলার ও রোমাঞ্চকর তথ্য দিয়ে ভরপুর এই বইটি।
বইয়ের বিবরণঃ ইতিহাসের বই মানেই মনে হয় অনেক সাল-সংখ্যা থাকবে আর সেই সাথে অনেক একঘেয়েমি হবে! কিন্তু লস্ট ইসলামিক হিস্ট্রির এক অনন্য গুণ হলো লেখক বিভিন্ন সন তারিখ বাদ দিয়ে বইটি খুব আকর্ষণীয় করে লিখেছেন। বইটি পড়ে কোনো অংশে মনে হয়নি এটি একটি অনুবাদ গ্রন্থ। বইটির অনুবাদক অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাষায় অনুবাদ করেছেন।
আরব শব্দটি পর্যালোচনা করলে অর্থ দাঁড়ায় যাযাবর। একটি সভ্যতা মূলত সেই এলাকার পরিবেশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। আরব মরুভূমির দেশ। এই মরুভূমিকে কেন্দ্র করে সভ্যতা গড়ে ওঠা বেশ কঠিন। তাই বছরে যখন শীতকাল আসত তখন তারা ইয়েমেনের দিকে অগ্রসর হতো আর গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় পাড়ি দিত। এভাবেই তাদের যাযাবর জীবন কাটত।
আরবদের ভাষা ছিল সবচেয়ে আকৃষ্টকারী। আরবী ভাষা যেমন সহজ তেমনি শ্রুতিমধুর। তাদের স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখর ছিল। ইসলামপূর্ব আরবরা একাধিক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতো। ভূপ্রকৃতিগত ভাবে আরব দেশ ছিল তিনটি মহাদেশের কেন্দ্রস্থল। চারপাশে মরুভূমি থাকার কারণে তাদের ক্ষতি কেউ করতে পারত না। একটা সময় পর তারা বিভিন্ন রাজ্য জয় করার সাহসিকতা অর্জন করল আর যাযাবর জীবনকাল থেকে মুক্তি পেলো।
বইয়ে রাসূল (সা.) এর জীবনীর প্রাথমিক ধারণা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি ৫৭০ সনে মক্কার কুরাইশ বংশের বনু হাশিম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন।জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর জন্মের ৬ বছর পর মা আমিনা মারা যান। রাসূল (সা.) এর দাদা মারা যাবার পর চাচা আবু তালিবের কাছেই তিনি বেড়ে উঠেন। ছোটবেলা থেকেই আমাদের প্রাণের নবী এতিম। অনেক কষ্ট যন্ত্রণা তিনি সহ্য করেছেন। তারপরেও ইসলামের জন্য যে ত্যাগ তিনি প্রতিনিয়ত করেছিলেন সেটা তাঁর উম্মতদের জন্য অনেক অনুপ্রেরণাময়। মক্কার কাফের মুশরিকরা কত নির্মম অত্যাচার উনাকে করেছেন, এর সুস্পষ্ট ধারণা পাঠক পাবেন। রাসূল (সা.) এর বয়স যখন ৪০ বছর তখন তাঁর উপর প্রথম ওহী নাযিল হয়। ইসলামের বানী প্রচারের কারণে তাঁকে তাঁর জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যেতে হয়। এই ঘটনাকে হিজরত বলা হয়। এই দুঃসময়ে রাসূল (সা.) কে মানসিকভাবে সাহায্য করে গেছেন তাঁর প্রথম সহধর্মিণী খাদিজা (রা.)। তাঁর জীবনকালে নবুওয়াত প্রাপ্তির ১৩ বছর মক্কায় এবং ১০ বছর মদিনায় কাটিয়েছেন।
রাসূল (সা.) এর ওফাতের পর মুসলিমদের নেতৃত্ব দেবার জন্য ৪ জন খলিফা নিযুক্ত হোন। নবী (সা.) যেভাবে মদিনাকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন,সেই চেতনাকে ধারণ করে মুসলিমদের রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়াই ছিল খলিফার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন ক্রমান্বয়ে হযরত আবু বকর (রা.), উমর (রা.), উসমান (রা.), এবং হযরত আলী (রা.)। বইটিতে এই খলিফাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা পাঠক জানতে পারবেন।
ইসলামের ইতিহাসে ৮ম শতাব্দী থেকে ১৩শ শতাব্দী ছিল বিজ্ঞান, ধর্ম,দর্শন, এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবার অনন্য এক সময়।
আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন বাগদাদে অনন্য এক শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেন।এর নাম ছিল বায়তুল হিকমাহ বা হাউজ অব উইজডম। এছাড়াও পাঠক অনেক আগ্রহী হয়ে পড়বে বুদ্ধিবৃত্তিক সোনালী যুগ অধ্যায়টি। এই অধ্যায়ে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ আরো নানান বিষয় সম্পর্কে লেখা আছে যা মুসলিমরাই প্রথম আবিষ্কার করেছিল। বীজগণিত আবিষ্কার করেছেন ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি। চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশাল অবদান রেখেছেন ইবনে সিনা। তাঁরই লেখা The Canon of Medicine . এমন কোনো মেডিকেল শিক্ষার্থী নেই যারা বইটি সম্পর্কে জানেন না। এছাড়া পদার্থবিদ্যায় ইবনে হাইসামের অভাবনীয় আবিষ্কার পাঠকগণকে অভিভূত করবে।
ইসলামী জ্ঞান চর্চা অধ্যায়ে ফিকহ শাস্ত্র, আকিদাহ, সুফিজম সম্পর্কে চমৎকার ধারণা দেওয়া হয়েছে বইটিতে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম মালিক (রহ.), ইমাম শাফেয়ী( রহ.), এবং ইমাম হাম্বল (রহ.) এর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ইসলামে চারটি নতুন ধারার প্রচলন হয়। যেগুলোকে মাযহাব হিসেবে অভিহিত করা হয়। এছাড়াও শিয়া কী, কারা শিয়ার অনুসারী এ সম্পর্কে চমৎকার তথ্য দিয়েছেন লেখক।
মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল আকসা মসজিদ। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নানা লোমহর্ষক ঘটনা বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে। জেরুসালেম জায়গাটি মুসলিম,খ্রিষ্টান এবং ইহুদি সবার জন্যই একটি পবিত্র স্থান।এর আবির্ভাব খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বইটিতে।
চেঙ্গিস খান ও তার বাহিনীরা সারা বিশ্বে নিরীহ মানুষদের উপর যে নির্মম অত্যাচার ও নৃশংসতা চালিয়েছিল পাঠক তা পড়বে আর ভাববে তারা যেনো এক থ্রিলার কাহিনী পড়ছেন। মোঙ্গলরা যদিও অশিক্ষিত ছিল কিন্তু তারা যুদ্ধে খুব পারদর্শী ছিল। তাদের যুদ্ধের কৌশল কখনো প্রতিপক্ষ বুঝতে পারত না। যুদ্ধের পর মোঙ্গলরা মানুষের মাথা আলাদা করে ফেলত আর সেই কাটা মাথা দিয়ে সেখানে পিরামিড বানিয়ে আসত। অবশেষে এই চেঙ্গিস খানেরই বংশের একজনের হাত ধরে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসরাইলি বাহিনী অবৈধভাবে কীভাবে ফিলিস্তিনিদের জায়গা দখল করে আছে, ইসরাইলদের কারা অর্থ সম্পদ দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করছে পাঠকের কাছে তা সহজভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
কেনো বইটি পড়বঃ ইসলামপূর্ব জীবন থেকে শুরু করে ইসলাম পরবর্তী জীবন সম্পর্কে এত সুন্দর ও সংক্ষেপে আর কোনো বই আছে বলে আমার মনে হয় না। এর প্রতিটা পৃষ্ঠা এমন রোমাঞ্চকর যে বইটি শেষ না করা পর্যন্ত পাঠকের উঠতে ইচ্ছা করবে না। এরপর কী হবে ক্রমান্বয়ে জানার আগ্রহ কাজ করবে।
*১৪শ শতকে ইয়েমেনি মুসলিমরা প্রথম কফি আবিষ্কার করে।
*অটোম্যান সাম্রাজ্যেই সর্বপ্রথম গুটিবসন্ত রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়।
*পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো বিশ্ববিদ্যালয় হলো কারউইন বিশ্ববিদ্যালয়। যেটি প্রতিষ্ঠা করেছেন মরক্কোর ফেজ এলাকার একজন মুসলিম মহীয়সী নারী। এমন ছোট ছোট আরো অনেক তথ্য বইটিতে লেখক রেখেছেন।
বইটির দুই এক জায়গায় কিছু বানান ভুল থাকলেও এই ইতিহাস পড়ে পাঠক অনেক জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন বলে আশা ।লেখক বইটিতে বিতর্ক সৃষ্টি করে এমন লেখা এড়িয়ে চলেছেন লেখক। বইটির ইতিহাস জেনে পাঠক আনন্দ বেদনায় সিক্ত হবেন বলে মনে করি।
সামসুন নাহার শিক্ষার্থী, ইনফরমেশন সায়েন্স এন্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।