বাংলাদেশের বৃহত্তর জেলা গুলোর মধ্যে যশোর একটি। এটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এবং খুলনা বিভাগের আওতাধীন একটি জেলা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোর ছিল প্রথম শত্রু মুক্ত জেলা। প্রাচীন কাল থেকেই এই জেলাটি জ্ঞান চর্চার অগ্রসর। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মত কালজয়ী লেখকের জন্ম এই জেলায়। এছাড়াও আরো অনেক কীর্তিমান মানুষ এই জেলাকে শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
গ্রন্থাগার একটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। একটি দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির আতুরঘর বলা হয় গ্রন্থাগারকে। গ্রন্থাগার বিহীন একটি উন্নত জাতি কল্পনা করা যায়না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটি ব্যতিক্রম নয়। সূচনালগ্ন থেকে গ্রন্থাগার এদেশে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের ছাত্র থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের জ্ঞান চর্চার অন্যতম স্থান হচ্ছে পাবলিক লাইব্রেরি। আর বাংলাদেশের প্রথম যে চারটি পাবলিক লাইব্রেরির সূচনা তার মধ্যে একটি কিন্তু এই যশোরেই অবস্থিত। ১৮৫১ সালে যশোরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই লাইব্রেরি, পরবর্তীতে ১৮৫৪ সালে যশোর ইন্সটিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রায় বাহাদুর যাদুনাথ মজুমদার এই গ্রন্থাগারটিকে ‘নাট্য আর্য’ এবং ‘সিটি ক্লাব’য়ের সাথে একত্রিত করে ১৯২৭ সালে যশোরের জন্য একটি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গঠন করেন। প্রতিষ্ঠার সময় গ্রন্থাগারটির নাম এমন ছিলনা। পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক ‘যশোর ইন্সটিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি’ নামকরণ করা হয়েছিল।
গ্রন্থাগারটিতে পৃথক দুটি ভবন রয়েছে, একটি দোতলা এবং অপরটি তিনতলা। দোতলা ভবনটির নিচতলা প্রাতিষ্ঠানিক কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। উক্ত ভবটির দোতলা এবং তিনতলা ভবনটি গ্রন্থাগারিক কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন কাল হতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বই এই গ্রন্থাগারটিতে সুসজ্জিত রয়েছে। কালের বিবর্তনে বইয়ের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনোদন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ঐতিহাসিক, ব্যবসায়িক জ্ঞান সম্বলিত, আধ্যাত্মিক বই থেকে শুরু করে রন্ধনশিল্পের বিভিন্ন বই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ ছাত্র, কর্মজীবী এমনকি গৃহিণী সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জ্ঞানের চাহিদা পূরণে এই গ্রন্থাগারটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাছাড়া এই গ্রন্থাগারে বিভিন্ন ধরনের সাময়িকী, দৈনিক সংবাদপত্র ও প্রবন্ধ সংগ্রহীত রয়েছে যা গ্রন্থাগারের একটি নির্দিষ্ট টেবিলে পাঠকদের জন্য রাখা হয়। পাঠকরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী সাময়িকী কিংবা পত্রিকা পড়তে পারেন। দেশের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকা এ গ্রন্থাগারটিতে রাখা হয়। এছাড়া তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সম্বলিত পত্রিকাগুলো আলাদাভাবে একটি ডেস্ক’য়ে সংরক্ষিত হয়। এগুলোকে খন্ড হিসেবে বাঁধাই করে রাখা হয় কেননা একসময়ে এগুলো আর্কাইভস হিসেবে গণ্য হতে পারে। এটি এই গ্রন্থাগারের একটি সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনা যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। শ্রেণীকরণ ও সূচীকরণ’য়ের আদর্শ নিয়মানুসারে এ গ্রন্থাগারে বই পত্র পত্রিকা সাময়িকী ও অন্যান্য পাঠ সামগ্রী পাঠকদের সুবিধার্থে সুসজ্জিত অবস্থায় সাজিয়ে রাখা হয়।
যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরিতে প্রায় ২,৫০০ সদস্য রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ২০০ জন দাতা এবং আজীবন সদস্য। বই প্রদানের সুবিধাগুলি কেবল গ্রন্থাগারের সদস্যদের জন্য। সরকারী ছুটি এবং সাপ্তাহিক ছুটি ব্যতীত গ্রন্থাগারটি সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে সকাল ১০ টা হতে রাত ৮ টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে এই গ্রন্থাগারটি নানা চড়াই-উৎরাই পার করে এসেছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর দরুন গ্রন্থাগারটিতে বহুবার স্থানান্তরিত করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বিমানবাহিনী যশোর ইনস্টিটিউটে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যশোর যে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছিলেন তার পিছনেও এই সংস্থার অবদান অপরিসীম। কালের বিবর্তনে গ্রন্থাগারটি বহুবার ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও আধুনিক কাল পর্যন্ত সগৌরবে গ্রন্থাগার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে পুরোপুরি অবদান গ্রন্থাগারটির সাথে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাগারিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। গ্রন্থাগারটি যশোরের সামাজিক ও সাহিত্য সমাবেশের কেন্দ্রবিন্দু। শত চড়াই উৎরায় পেরিয়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর কৃষ্টি চর্চার লালন ক্ষেত্র হিসেবে এই গণগ্রন্থাগারটি অতিক্রম করেছে দেড় শতাব্দীকাল।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া ।
লেখক: আনিকা তাবাচ্ছুম গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিভাগ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, লালমাটিয়া, ঢাকা।