আনিকা তাবাচ্ছুম: আমাদের জীবন দৈর্ঘ্যের হিসাবে ছোট। শিশু হিসেবে জন্ম গ্রহণের মধ্য দিয়ে জীবন শুরু হয় আর মৃত্যুর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে। তবুও আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবনে কতশত গল্প রয়েছে, জীবনে কত উত্থান-পতনের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। মানুষের একটি সহজাত স্বভাব হচ্ছে ‘মানুষ সবসময় একে অপরের জীবনকে জানতে চায়’।
মানুষের এই সহজাত প্রবৃত্তির কথা মাথায় রেখে ব্যক্তিজীবনের সাথে ঘটে যাওয়া গল্প এবং কল্পনা শক্তির সাথে সন্ধি করে কবি-সাহিত্যিকরা যুগে যুগে গ্রন্থ রচনা করেছেন। বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে মানুষের জীবনের গল্প! এসব গ্রন্থ কখনো আমাদের বিনোদনের খোরাক হয়, কখনো আমাদের মন খারাপের সঙ্গী হয়, কখনো আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, কখনো আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করে, কখনো আবার জীবন চলার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। গল্প কিংবা উপন্যাস সবকিছু তো মানুষকে ঘিরে। আচ্ছা একবার ভাবুন তো এমন একটি গ্রন্থাগারের কথা যেখানে বই থাকবেনা, থাকবে মানুষ! ধরুন আপনি আত্মহত্যা থেকে ফিরে আসা মানুষের নতুন করে জীবন গোছানোর গল্প জানতে কোন বই নয় বরং এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে এমন একজন মানুষের কাছ থেকে তার জীবনের গল্প শুনলেন! রোমাঞ্চকর না বিষয়টা? ডেনমার্কে এমন একটি গ্রন্থাগার আছে যেখানে বইয়ের পরিবর্তে মানুষ থাকেন। এই গ্রন্থাগারে গিয়ে আপনি বই নয় বরং মানুষ পড়তে পারবেন অর্থাৎ মানুষের সাথে কথা বলতে পারবেন।
প্রিয় পাঠক ডেনমার্কের মানব গ্রন্থাগার নিয়ে বলার প্রারম্ভে আমি মানব গ্রন্থাগার ধারণাটি সম্পর্কে একটু সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে নিচ্ছি। মানব গ্রন্থাগার হচ্ছে এমন একটি অলাভজনক সামাজিক সংগঠন যা সমাজে বৈষম্য ও কুসংস্কারের শিকার এমন কিছু নিপীড়িত মানুষকে বই হিসেবে উপস্থাপন করে এবং সমাজের নানা পর্যায়ের বৈষম্য ও কুসংস্কার সম্পর্কে আলোচনা করে। মানব গ্রন্থাগার ধারণাটিকে গ্রন্থাগার হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এখানে সাধারণ গ্রন্থাগারের ন্যায় বই থাকেনা, বরং মানুষকে বই হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আগ্রহী পাঠকরা গ্রন্থাগারের সেচ্ছাসেবক অর্থাৎ যারা মানব বই হিসেবে কাজ করেন তাদের কাছ থেকে ৩০ মিনিট সময় ধার নিয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা ও প্রয়োজনে প্রশ্ন করতে পারেন। যদি নির্ধারিত ৩০ মিনিটে আলোচনা শেষ না হয় তাহলে অতিরিক্ত ১০ মিনিট চেয়ে আবেদন করতে পারেন।
চলুন এবার ডেনমার্কের মানব গ্রন্থাগারের সূচনা ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করি। ২০০০ সালে ডেনমার্কের স্থানীয় সংগীত উৎসব Roskilde Festival’য়ে একটি প্রকল্প হিসাবে যাত্রা শুরু করে মানব গ্রন্থাগার। ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত এই সংগীত উৎসবে একদল তরুন “মানব গ্রন্থাগার” নামে একটি ইভেন্ট চালু করেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন রনি ও তার সহদোর ড্যানি আবারগেল এবং তার সহকর্মী আসমা মৌনা ও ক্রিস্টোফার এরিকসেন। পরবর্তীতে এটি Danish Youth NGO Stop Volden (Stop the Violence) এর সাথে সংযুক্ত হয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যায়। Danish Youth NGO Stop Volden (Stop the Violence) সংস্থাটি আমেরিকান স্টপ দ্য ভায়োলেন্স আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত। Roskilde Festival’য়ে অনুষ্ঠিত মানব গ্রন্থাগার ইভেন্টটি দৈনিক আট ঘন্টা করে মোট ৪ দিন কথোপকথন চালু রেখেছিল এবং এতে ১০০০ এরও বেশি লোক অংশ নিয়েছিল।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের একটি খোলা বই হিসাবে ধার নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে ৫০ জনেরও বেশি লোক প্রকাশিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজন মুসলিম, একজন সাংবাদিক, প্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল ক্লাব Brondby ও FC Copenhagen এর খেলোয়াড়, পুলিশকর্মী, পার্কিং অফিসার, ফ্রিটাউন ক্রিশ্চিয়ানার নামের একজন নারী (‘খারাপ’ প্রতিবেশি হিসেবে দেখানোর জন্য), সংখ্যালঘু, আদিবাসী, যৌনকর্মী, সমকামী, ট্রান্সজেন্ডার, আত্মহত্যা চেষ্টাকারী উপস্থিত ছিলেন মানব বই হিসেবে। এছাড়াও আরো অনেক শ্রেণী-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমান বিশ্বে মানব বই খুবই গুরত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে, মানব বইয়ের সুবিশাল সংগ্রহ পাঠকদেরকে পছন্দমত মানব বইয়ের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। ফলে তারা সামনে বসে থাকা বই স্বরূপ মানুষটির সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক সংস্কার ও জীবনযাপন সম্পর্কিত বিষয়ে ইচ্ছামত প্রশ্ন ও আলোচনা করতে পারেন। এই ভিন্নধর্মী ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিতে হাজারেরও বেশি পাঠক মুদ্রিত বইয়ের পরিবর্তে মানব বইয়ের এই সুযোগটি লুফে নেন। মানব গ্রন্থাগারের বইয়ের শেলফ থেকে প্রাপ্ত প্রতিটি মানব বই সমাজের এমন একটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে যা প্রায়শই কুসংস্কার, কলঙ্ক বা হতাশার শিকার হয়। তাদের জীবনধারা, বিশ্বাস, অক্ষমতা, সামাজিক অবস্থান, জাতিগত উৎসব ইত্যাদির কারণে প্রায়শই বৈষম্যের স্বীকার হয়।
মানব গ্রন্থাগারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে তিনটি। মূল লক্ষ্যগুলো হলো-
১.সমাজের বিভিন্ন সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক দলকে একত্রিত করা।
২.কুসংস্কার, চক্রান্ত এবং সমাজে বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করা।
৩. মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সংকীর্ণ মনোভাব পরিবর্তন করতে সাহায্য করা।
এই লক্ষ্য গুলোর মাধ্যমে বৈষম্যের শিকার মানুষের জীবন সংগ্রাম তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের জীবনমান উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব। এমন অনেক বিশেষ শ্রেণীর মানুষ সমাজে বসবাস করেন যারা সামাজিকভাবে বিতর্কিত। মানব গ্রন্থাগারে পাঠকের সাথে অনেক বিশেষ শ্রেণীর মানুষের আলোচনার মাধ্যমে তাদের সামাজিক প্রতিকুলতা তুলে ধরা সম্ভব। এছাড়া এধরনের কর্মশালা অনুষ্ঠিত হলে তার মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তিদের সামাজিক প্রতিকূলতা দূর করে সামাজিক স্বীকৃতি প্রদান পূর্বক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
ঠিক এভাবেই ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের মানব গ্রন্থাগারে বই সদৃশ যে মানুষরা রয়েছেন তাদের জীবনমান উন্নয়নে মানব গ্রন্থাগার কমিটি কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের জন্য গৃহ নির্মাণ থেকে শুরু করে তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। যা নিঃসন্দেহে মহৎকর্ম। ২০২০ সালের বসন্ত উৎসবে ডেনমার্কের এই মানব গ্রন্থাগারটি তাদের ২০ বছর পূর্তি উদযাপন করে। সূচনা লগ্নে মানব গ্রন্থাগারটি ক্ষুদ্রাকারে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এর পরিধি ব্যাপক। বিশ্বের প্রায় ৮০ টি দেশে এর কার্যক্রম চালু আছে। কিছু দেশে স্থায়ী মানব গ্রন্থাগার থাকলেও অধিকাংশ দেশে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ইভেন্ট আকারে এর গ্রন্থাগার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
মানব গ্রন্থাগারের মাধ্যমে একদিকে যেমন আমরা সমাজে বৈষম্যের শিকার মানুষের জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে পারছি অন্যদিকে তাদের দুঃখ-দুর্দশা কমিয়ে জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করা সম্ভব হচ্ছে। গ্রন্থাগারিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং পাঠকরা ও নিপীড়িত মানুষ (মানব বই হিসেবে কাজ করা ব্যক্তিবর্গ) এই মানব গ্রন্থাগারের কার্যক্রমে বিমোহিত হয়। এটি একদিকে যেমন গ্রন্থাগার অন্যদিকে নিপীড়িত মানুষের জন্য সাহায্যকেন্দ্র। রনি, ড্যানি আবারগেল, আসমা মৌনা ও ক্রিস্টোফার এরিকসেন এর এই উদ্যোগ মানব সমাজ থেকে কুসংস্কার ও বৈষম্য দূরীকরণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এই মানব গ্রন্থাগারের বিস্তৃত প্রচার ও প্রসার একটি সুস্থ ও মানববান্ধব সমাজের জন্য খুবই জরুরি।
তথ্যসূত্রঃ
- উইকিপিডিয়া, www.humanlibrary.org
- ছবিসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
লিখেছেন: আনিকা তাবাচ্ছুম গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিভাগ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, লালমাটিয়া, ঢাকা।