অদ্ভুত কিন্তু মনোহরী, তরঙ্গসঙ্কুল নিরুত্তাপ কিন্তু তীব্র তেজালু একটি উপন্যাসের কথা বলবো আজ। লিখছি প্রাণের রবিঠাকুরের উপন্যাস নৌকাডুবি নিয়ে। নৌকাডুবি ররিঠাকুরের প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে চতুর্থ। রবিঠাকুরের সব গঠন নির্মান-বিন্যাসের মাঝে বরাবরই একরকমের পরাবাস্তবতা কাজ করে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জীবন, মানবীয় জানকী যুদ্ধ যেনো রবিঠাকুরের গ্রন্থনায় অনাহুত আখ্যান। আদ্যাশক্তির অনুরাগ, প্রকৃতির অপার শোভনীয় শোভায় বিমোহিত হওয়ার বর্ণনা, ভাব ভাবনা কিংবা মানবিক সম্পর্কের গোলমেলে সমীকরণের সমীক্ষ, মনোজগতের জটিল গতিবিধির বর্ণনা এসবই তো রবিঠাকুরের রচনার মূল উপজীব্য। এইসব চিরায়ত নিয়ম মেনেই মূলত রচিত হয়েছে নৌকাডুবি উপন্যাসটি। কালবৈশাখী ঝড়োনিশানে সফেন সমস্ত ওলট-পালট হওয়ার একথা-সেকথা, ভাগ্যের ভুজে চারটি মানুষের প্রাণ নিয়ন্ত্রিত হবার উপকাহিনী হলো এই নৌকাডুবি। চরিত্রপ্রধান নৌকাডুবি উপন্যাসে রমেশ, হেমনলিনী, কমলা ও নক্ষিনাক্ষকে প্রবৃত্তি করে ঘটনা এগিয়েছে। চক্রবর্তী খুড়ো, হেমনলিনী মন্ত্রমুগ্ধ অক্ষয়, দুহিতার সুখদুঃখাদির বোধ্য অন্নদাবাবু, কমলার বাৎসল্য উমেশ, স্নেহেরে প্রতিমূর্তি ক্ষেমংকরী, যোগেন্দ্র ও শৈলজাকে ঘিরে পুরো উপন্যাসটি আবর্তিত। নৌকাডুবি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রমেশ পেশায় একজন আইনজীবি। প্রণয়াসক্ত রমেশের সাথে হেমনলিনীর অভিব্যক্তিহীন অস্ফুট সুক্ষ্ম প্রণয়। দুজনের কেউ কাউকে কখনো কিছু বলেনা তবু তাঁরা দুজনেই দুজনার সমর্থ সাঁতারে ডুবজলে ডুবসাঁতার। বক্ষঃস্থুল্য এরকম জটিল সদৃশীকরণের অন্তরালে জীবদ্দশার কোনো না কোনো বেলা পার করতে হয় আমাদের কিন্তু তা অনন্তকালই থাকে অব্যক্ত। এই মনস্তাত্ত্বিক অনুভবটি রবি ঠাকুর আমাদের জানিয়েছেন রমেশ আর হেমনলিনীর চরিত্র অংকনের মধ্য দিয়ে। হেমাসক্ত রমেশ তার জনকের দুরুহ তাম্রদমনের চাপে পত্রপল্লীতে গিয়ে অন্যথা দারপরিগ্রহে বাধ্য বরনীয় হয়। বিবাহ শেষে নববধূ নিয়ে নদীপথে ফেরার সময় বাধেঁ মহা বিপত্তি। ঝড়োনিশানে সফেন সমস্ত উল্টেপাল্টে ঘটে মহা নৌকাডুবি। কন্যাযাত্রীর অন্যান্য বিধিপ্রদর্শকদের সাথে নিজের পিতা এবং শ্বাশুড়িবিহীন রমেশ পদ্মার চরে খুঁজে পাওয়া নববধূকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। বাস্তবতার ব্যস্ততা মেনে নিয়ে হেমাক্তি থেকে মন ছুটিয়ে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে ঘরকন্না সাজানোর জন্য মনস্থির করে তখনি হঠাৎ তার সামন্তে আসে নিষ্ঠু্র প্রকৃতি। পদ্মা চরে সে যাকে খুঁজে পেয়েছে সে তার পরিণীতা নয়। অন্যকোন বরযাত্রীর ডুবন্ত নৌকার নববধূ। এইখানেই এই উপন্যাসের ক্লাইমেক্স। মানুষে মানুষে সংযোগ, ঝঞ্জাঝাপটা বাদলামন, ইন্দ্রজাল, বিভ্রান্তি, মোহ, হৃদ্যতা, নির্বাহতা যেন রবিঠাকুর সুনিপুণ হাতে গাঁথামালার মত গেঁথেছেন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি নৌকাডুবি উপন্যাসে।
পদ্মা চরে সে যাকে খুঁজে পেয়েছে সে তার পরিণীতা নয়। অন্যকোন বরযাত্রীর ডুবন্ত নৌকার নববধূ। এইখানেই এই উপন্যাসের ক্লাইমেক্স। মানুষে মানুষে সংযোগ, ঝঞ্জাঝাপটা বাদলামন, ইন্দ্রজাল, বিভ্রান্তি, মোহ, হৃদ্যতা, নির্বাহতা যেন রবিঠাকুর সুনিপুণ হাতে গাঁথামালার মত গেঁথেছেন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি নৌকাডুবি উপন্যাসে।
এই উপন্যাসে কমলা চরিত্রটি যেন মায়াবতী বাঙালী কামিনীমনের চিরায়মানা স্বরূপ। বয়ঃপ্রাপ্তির কিশোর উমেশের প্রতি কমলার যে মমতা তা প্রমাণপঞ্জী করে নারীমন যে বয়সীই হোক তার ভেতরে প্রথমে জাগে মাতৃত্ব। দোটানায় থাকা রমেশ কিনারা করতে পারেনা চারপেয়ো সংসারজীবনে। হেমের প্রেমে না সে কমলাকে কাছে রাখতে পারছে, না সে হেমনলিনীকে বিয়ে করতে পারছে। এদিকে হেমও রমেশের বিরহে প্রচন্ড কাতর হয়ে পড়ে। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে নলিনাক্ষের সাথে কমলার মিলন হয়, কিন্তু হেমর সাথে রমেশের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল কিনা, উপন্যাস সে সম্পর্কে নীরব। কমলা যখন সুদীর্ঘ বিরহের অপেক্ষা শেষে নলিনাক্ষের সাথে পুনর্মিলিত হয়, তখন কমলার মনের ভাব লেখক প্রকাশ করেছেন এভাবেঃ “……দুঃসহ লজ্জা আর তাহাকে পীড়ন করিল না। হর্ষের উল্লাস নহে কিন্তু একটি বৃহৎ মুক্তির অচঞ্চল শান্তি তারার অস্তিত্বকে প্রভাতের অকুন্ঠিত উদারনির্মল আলোকের সহিত ব্যপ্ত করিয়া দিল। একটি গভীর ভক্তি তাহার হৃদয়ে কানায় কানায় পূর্ণ হইয়া উঠিল, তাহার অন্তরের পূজা সমস্ত বিশ্বকে ধূপের পূণ্য গন্ধে বেষ্টন করল। দেখিতে দেখিতে কখন অজ্ঞাতসারে তাহার দুই চক্ষু ভরিয়া আসিল; বড় বড় জলের ফোটা তাহার দুই কপোল দিয়ে ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, আর থামিতে চাহিল না, তাহার অনাথ জীবনের সমস্ত দুঃখের মেঘ আজ আনন্দের জলে ঝরিয়ে পড়িল…” হেমকে দেখতে না পেয়ে রমেশ পূর্ব স্মৃতি রোমন্থন করেছিল এভাবেঃ “এ কী বিস্ময়! এই জনপূর্ণ নগরের মধ্যে ঐ সামান্য গৃহের ভিতরে একটি মানবীর বেশে এ কী বিস্ময়! এই রাজধানীতে কত ছাত্র, কত উকিল, কত প্রবাসী ও নিবাসী আছে, তাহার মধ্যে রমেশের মত একজন সাধারণ লোক কোথা হইতে একদিন আশ্বিনের পীতাভ রৌদ্রে ঐ বাতায়নে একটি বালিকার পাশে নীরবে দাঁড়াইয়া জীবন ও জগতকে এক অপরিসীম-আনন্দময় রহস্যের মাঝখানে ভাসমান দেখিল—এ কী বিস্ময়! হৃদয়ের ভিতরে আজ এ কী বিস্ময়! হৃদয়ের বাহিরে আজ এ কী বিস্ময়!” “আমরা যাহা পাইয়াছি, তাহা কখনোই হারাইতে পারিনা, যাহা যথার্থ পাই নাই তাহাই হারাই।” হয়তো এই একটি বাক্যেই রবিঠাকুর পুরো উপন্যাসকে ব্যক্ত করেছেন। ভীষণ ভাববিশেষিত নৌকাডুবি পড়ার সময় কখনো আপনার চোখে ভেসে উঠবে উন্মত্ত পদ্মা, তুমুল ঝড়োঢেউ, খেই হারানো ডিঙি নৌকা, কখনোবা রমেশের হতবুদ্ধি চেহারা, কখনো হয়তো কমলার ভীত, সংক্ষিপ্ত চাহনী। গ্রামবাংলার চিরায়ত পৃকতি, ক্রমবর্ধমান কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের যাপিত জীবন, আবার কখনোবা পশ্চিম ভারতীয় প্রবাসী বাঙালী জীবন! সবমিলিয়ে অদ্ভুত আশ্চর্যে মোড়ানো একটি অনুভূতিপ্রবণ উপন্যাস “নৌকাডুবি”।
সোহানা হোসেন নিশি
- শিক্ষার্থী, ইনফরমেশন সায়েন্স এন্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়