আরেফিন আলভী
“বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না” ~সৈয়দ মুজতবা আলী বই মানুষের মনের খোরাক মেটায়। আর আমাদের মনের সৌন্দর্য বাড়ায়। বিশ্বের লাখো-কোটি বইপ্রেমীদের পদচারণায় মুখর হয়ে থাকে বিভিন্ন দেশে দেশে আয়োজিত বইমেলাগুলো। বইমেলায় লেখক-পাঠকের যেমন মেলবন্ধন গড়ে ওঠে, ঠিক তেমনি মেধা, মনন এবং সৃজনশীলতারও সম্মিলন ঘটে। বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বইমেলা নিয়েই এবারের প্রতিবেদন।
১. ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা জার্মানি :
বানিজ্যিক দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা হচ্ছে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। বলা হয়ে থাকে, এটির বয়স প্রায় পাঁচশো বছর বা তারও বেশি। শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে।প্রত্যেক বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারক ইয়োহানেস গুটেনবার্গ থাকতেন ফ্রাঙ্কফুর্টের সামান্য দূরের মেঞ্জ শহরে। তার আবিষ্কৃত ছাপাখানার যন্ত্র বইয়ের জগতে নিয়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তিনি নিজের ছাপাখানার যন্ত্রাংশ এবং ছাপানো বই বিক্রির জন্য ফ্রাঙ্কফুর্টে আসেন। গুটেনবার্গের দেখাদেখি ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের স্থানীয় কিছু বই বিক্রেতাও তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে বসতে থাকে। আর এগুলো কিনতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষও আসতে শুরু করে।
সেই আসা-যাওয়া থেকেই জমে উঠতে থাকে ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা। বইয়ের আন্তর্জাতিক বাজার তৈরিতে এ মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। গেস্ট অব অনার হিসেবে প্রতি বছর কোনো একটি দেশকে বেছে নেয়া হয়। সে দেশের সাহিত্যের ওপর আলোকপাত করা হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায়। অতিথি দেশের জন্য বিশেষ প্রদর্শনী হলের ব্যবস্থাও করা হয়। বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলা তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালে এ মেলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় জার্মান প্রকাশক সমিতি। আর ১৯৬৪ সাল থেকে এ মেলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে।
২. আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা :
কলকাতার একটি শীতকালীন মেলা। এটি বই এর বাণিজ্য মেলা নয় বিধায় একটি অনন্য বই মেলা। এটি বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যহীন বই মেলা, এশিয়ার বৃহত্তম বইমেলা এবং সর্বাধিক উপস্থিতির বইমেলা। এটি ফ্র্যাঙ্কফুর্ট বইমেলা এবং লন্ডন বইমেলার পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বার্ষিক সমষ্টি। এতে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। তাই, এটি বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা। কলকাতা বইমেলার সাফল্যের ফলস্বরূপ শিলিগুড়ির মতো পশ্চিমবঙ্গের ছোট ছোট শহরগুলিতে অনেক বইমেলা শুরু হয়েছিল এবং ১৯৭২ সালে নয়াদিল্লিতে প্রথম বিশ্ব পুস্তক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, ২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাতে ভারত অতিথির সম্মানে মনোনীত হয়। এবং, তাতে কলকাতা বইমেলার জনপ্রিয়তা ছিল চূড়ান্ত।
৩. লন্ডন বুক ফেয়ার (এলবিএফ) :
এটি বিশ্বের অন্যতম বড় বই-প্রকাশনা বাণিজ্য মেলা। যেটি সাধারণত এপ্রিল মাসে ইংল্যান্ডের লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়। যেকোনো ধরনের প্রিন্ট, অডিও, টিভি, ফিল্ম এবং ডিজিটাল চ্যানেলগুলিতে সামগ্রীর বিক্রয় ও বিতরণে এলবিএফ একটি বিশ্বব্যাপী বাজার। ৫০ তম ইভেন্টটি ২০২০ সালে হওয়ার কথা ছিল তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে বাতিল করা হয়েছিল।
৪. বুক এক্সপো আমেরিকা :
(সাধারণত বই প্রকাশনা শিল্পের মধ্যে বিইএ হিসাবে পরিচিত) এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বার্ষিক বই বাণিজ্য মেলা। বিইএ প্রায় সবসময়ই মে মাসের শেষের দিকে অথবা জুনের শুরুর দিকে চার দিন ধরে একটি বড় শহরে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমস্ত উল্লেখযোগ্য বইয়ের প্রকাশক এবং বিদেশ থেকেও অনেকগুলি প্রকাশকদের বিইএতে বুথ থাকে এবং তাদের বিই এর প্রদর্শনী চলতে থাকে। এবং মেলাটি আসন্ন শিরোনামগুলি প্রদর্শন করার জন্য, বর্তমান বই বিক্রি করার, অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থাগুলির সহকর্মীদের সাথে সামাজিকীকরণ এবং বিক্রয় এবং কেনার সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করে সেল সহায়ক ও আন্তর্জাতিক অধিকারসমূহ। লেখক, গ্রন্থাগারবিদ এবং বই খুচরা বিক্রেতাদের জন্য ক্রেতারাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন।
৪. আবু ধাবি আন্তর্জাতিক বইমেলা :
এটি আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত একটি বার্ষিক বইমেলা। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করে যেখানে প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতারা, এজেন্টস, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং প্রেসগুলি দেখা করতে পারে, ধারণা বিনিময় করতে পারে এবং ব্যবসায়ের সুযোগগুলি সনাক্ত করতে পারে। ২০০০ সাল থেকে এটি আবুধাবি কর্তৃপক্ষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার মধ্যে একটি যৌথ উদ্যোগ, কিতাব দ্বারা আয়োজিত হয়েছে। এডিআইবিএফ আরব এবং অসংখ্য আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সম্প্রদায়কে একত্রিত করেছে। মেলাটি পুরো মেনা অঞ্চলে প্রকাশকদের অ্যাক্সেস সরবরাহ করে এবং বইয়ের অধিকার এবং লাইসেন্সিংয়ের আলোচনা ও বিক্রয় সম্পর্কিত এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মিলন। মেলার চলমান সাংস্কৃতিক (কিতাব সোফা) এবং পেশাদার প্রোগ্রামের অংশ হিসাবে ইভেন্টগুলিও হোস্ট করা হয়।
৬. অমর একুশে বইমেলা :
এই বইমেলাকে বলা হয় বাঙালির প্রাণের মেলা। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসেই বাংলা ভাষাকে রাস্ট্রভাষা করার দাবীতে নিজেদের প্রান সপে দিয়েছিলেন এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা। তাদের এই অসামান্য অবদানকে স্বরণীয় করে রাখতেই রাজধানী ঢাকায় পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়ে চলে এই মেলা৷ ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে এদেশে প্রথম বইমেলার গোড়াপত্তন করেন৷ ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন৷ পৃথিবীতে যত বইমেলা হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে চলে বাংলাদেশের এই প্রানের বইমেলা।
লেখকঃ আরেফিন আলভী
শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ