সংস্কৃত ন হন্যতে’র বাংলা হয় যার ক্ষয় নেই, মৃত্যু নেই, বিনাশ নেই। এটি মূলত একটি আত্নজৈবনিক উপন্যাস। ‘ন হন্যতে’ নিয়ে বলতে গেলে বলতে হবে ‘লা নুই বেঙ্গলী’ নিয়েও। ছেলেবেলার প্রেমিক মির্চা এলিয়াদের (লেখকের ভাষায় মির্চা ইউক্লিড) রোমানিয়ান ভাষায় লেখা ‘মৈত্রেয়ী’র (ফরাসি-লা নুই বেঙ্গলী, ১৯৫০; ইংরেজি-বেঙ্গল নাইটস, ১৯৯৩) প্রতিউত্তর হিসেবে মৈত্রেয়ী দেবী লেখেন ‘ন হন্যতে’। ‘লা নুই বেঙ্গলী’ প্রথম প্রকাশের প্রায় চার দশক পর প্রকাশিত হয় ‘ন হন্যতে’। ১৯৭৬ সালে ‘ন নহ্যতে’র জন্য মৈত্রেয়ী দেবী সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর। ১৯৩০ সাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সংস্কৃত ভাষার পন্ডিত সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত একদিন বাড়িতে নিয়ে এলেন তাঁর এক ইউরোপিয়ান ছাত্র মির্চা এলিয়াদকে। বাড়ির একটি ঘর বরাদ্দ হলো তাঁর থাকার জন্য। উদ্দেশ্য মির্চা এই পরিবারে ছেলের মতো থাকবে এবং পরিবারের সদস্যরাও ভিনদেশী এই মানুষটির সংস্পর্শ পাবে। ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে প্রবল আগ্রহ থাকায় মির্চাও একসময় মিশে গেলেন পরিবারটির সাথে। কলকাতার এই বিদ্ব্যত সমাজের পারিবারিক আবহে এসে মির্চার পরিচিতি বাড়তে থাকে বাঙালির পারিবারিক-সামাজিক সংস্কৃতির সাথে। মির্চার শিক্ষক গৃহকর্তা সুরেন্দ্রনাথ তাঁর বড় সন্তান ষোড়শী কন্যা অমৃতাকে (মৈত্রেয়ী দেবী) দ্বায়িত্ব দেন এই বিদেশি তরুণকে বাংলা শেখানোর এবং মির্চাকে ভার দেন অমৃতাকে ফরাসি শেখানোর। কিন্তু ঘটনাক্রমে এই দুই তরুণ-তরুণী একে অন্যের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। তবে খৃষ্টান মির্চা আর হিন্দু অমৃতার সেই প্রেম আর পূর্ণতা পায়নি। এই প্রণয়ের কথা জানা-জানি হলে সুরেন্দ্রনাথ মির্চাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এরপর আরও কিছুদিন ভারতে ছন্নছাড়া জীবনযাপন করে মির্চা ইউরোপে ফিরে যান। সেখানে ১৯৩৩ সালে তাঁদের প্রণয় কাহিনী নিয়ে রোমানিয়ান ভাষায় “মৈত্রেয়ী” লিখেন। মূলত উপন্যাসটির ফরাসি অনুবাদ “লা নুই বেঙ্গলি” প্রকাশের পর এটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে মির্চা এলিয়াদ একজন প্রখ্যাত ধর্ম তাত্ত্বিক, লেখক ও দার্শনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ঘর-সংসারও শুরু করেন। ততদিনে মৈত্রেয়ী দেবীও ড. মনোমোহন সেনকে বিয়ে করে সংসারি হন।
মৈত্রেয়ী দেবী তাকে নিয়ে লেখা ‘লা নুই বেঙ্গলী’ সম্পর্কে জেনেছেন অনেক পরে। জেনেও বহুদিন এটা নিয়ে খুব একটা গা করেননি। এমনকি উনিশশত তিপ্পান্ন এবং ছাপ্পান্ন সালে ইউরোপ ভ্রমণে গেলেও মির্চা সম্পর্কে খুব বেশি খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি তিনি। এর বহু বছর পর ১৯৭২ সালে এক বন্ধুর মাধ্যমে ফরাসি থেকে অনুবাদ করিয়ে বইটি পড়েন এবং বইয়ে মির্চা তাঁদের শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন জেনে মর্মাহত হন। একই সাথে তিনি অনুভব করেন একবারের জন্য হলেও মির্চার সাথে তাঁর দেখা হওয়া উচিৎ-‘ওকে একবার দেখে আসতে আমার হবেই। ’

দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছর পর জীবনের প্রথম প্রেম আবার ঝড় তোলে মৈত্রেয়ীর জীবনে। সুযোগও আসে। আমেরিকার শিকাগোতে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় রবীন্দ্রনাথের উপর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। মির্চা তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির এক কোণায় দেখা হয় মির্চা আর মৈত্রেয়ীর।
বেশ কিছু চিঠি লিখেও কেন উত্তর পাননি মৈত্রেয়ীর এমন প্রশ্নের জবাবে মির্চা বলেন- “ঐ তো বলছি আমার সেই অতুলনীয় অভিজ্ঞতা এত সুন্দর যে আমি ভাবিনি আর তাকে স্পর্শ করা যায়-তাই তোমাকে আমি দেশকালের অতীত করে রেখে দিয়েছি।”
সাহিত্যের মানদন্ড শুধু লেখার কারুকার্যে নয় বরং তার জীবন ঘনিষ্টতার ওপরও নির্ভর করে। লেখকের ব্যক্তিজীবনের অনুভব যখন লেখক নিজেই লিখতে বসেন তখন নিঃসন্দেহে সেই কাজের সাহিত্য আবেদন বহুগুণ বেড়ে যায়।

পুরো ‘ন হন্যতে’ জুড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে মৈত্রেয়ী দেবীর হৃদ্যতার পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। যখনই কোন মানসিক সংশয়ে ভুগেছেন, ছুটে গেছেন কবির কাছে। কবিও তাঁর স্নেহমাখা জীবনবোধ থেকে সমাধান দিয়ে গেছেন। এমনকি স্বামীর চাকুরীর সুবাদে মৈত্রেয়ী দেবী যখন দার্জিলিংয়ের মংপুতে থাকতেন তখন কবিগুরু বেশ কয়েকবার তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সেখানে গিয়েছিলেন। হিমালয়ের পাদদেশের পাহাড়ের ওপর বরফ ঢাকা শহর মংপুর অপূর্ব নৈসর্গিক শোভা কবিকে মুগ্ধ করেছিল। পরবর্তীতে মৈত্রেয়ী দেবীর এই বাড়িটিকেই রবীন্দ্র যাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়।
মির্চা এলিয়াদ মৈত্রেয়ী দেবীকে কথা দিয়েছিলেন তাঁদের দুজনের জীবনকালে ‘লা নুই বেঙ্গলী’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হবে না। সে অনুযায়ী মৈত্রেয়ী দেবীর মৃত্যুর চার বছর পর ১৯৯৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস হতে প্রকাশিত হয় এর ইংরেজি অনুবাদ। পরের বছরই শিকাগো প্রেস দুটো উপন্যাসকেই ভলিউম আকারে একই মলাটে প্রকাশ করে।
অপরদিকে মির্চা এলিয়াদের ‘লা নুই বেঙ্গলী’র উপর ভিত্তি করে ১৯৮৮ সালে পরিচালক নিকোলাস ক্লতজ নির্মাণ করেন ‘দ্যা বেঙ্গলী নাইট’ নামে সিনেমা। এতে মির্চা এলিয়াদ ও মৈত্রেয়ী দেবীর চরিত্রে অভিনয় করেন হিউগ গ্রান্ট ও সুপ্রিয়া পাঠক। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া সঞ্জয় লীলা বানসালি পরিচালিত ‘হাম দিল দে চুকে সানাম’ চলচ্চিত্রটির কাহিনী এই উপন্যাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও পরিচালক সেই ঋণ স্বীকার করেন নি।