কনক মনিরুল ইসলাম
দিন তারিখ কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে সেদিন ছিল রৌদ্রোউজ্জ্বল আকাশ, তপ্ত সূর্য অক্লান্তভাবে তাপ ও আলো দুটোই দিচ্ছিলো। অফিসে বসে হাতের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো শেষ করছিলাম। এমন সময় দেখি পরিপাটি আঁচড়ানো চুল, তামাটে ফর্সা গায়ের রং, কালো ফ্রেমের চশমা-পরা কিন্তু উজ্জ্বল স্বপ্নভরা চোখ ঠিকই উঁকি দিচ্ছে চশমার ভিতর থেকে। দেখতে একটু বয়স্ক মনে হলেও তারুণ্যে ভরা উদ্দীপনা।
ঠিক এমন একজন মানুষ আমার রুমে প্রবেশ করলো। হাত বাড়িয়ে দিয়েই বলল, ‘‘ড. রেজা, চেয়ারম্যান, বেলিড’’। আমি আমার পরিচয় দিতে যাচ্ছিলাম, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘থাক বলতে হবে না, আমি কিন্তু আপনাকে চিনি।’’ অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। কিন্তু আশ্চর্য হলাম সামনে বসা মানুষটি সব কথাই গ্রন্থাগার, গ্রন্থাগার পেশাজীবী আর বেলিড নিয়ে। বুঝতে দেরি হলো না গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিকতা নিয়েই তাঁর স্বপ্ন। এই মানুষটি যেন গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগার পেশাজীবীদের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। একটু বিরক্তই হলাম। চোখে রঙ্গিন চশমা তখন, সদ্য পাশ করে বেরিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, নতুন আরো ভালো চাকুরির প্রত্যাশায় আছি। চোখ তখন শুধুমাত্র চাকুরির বইয়ের পাতায়। এই পেশা নিয়ে আমি বিরক্ত, চেষ্টা করছি এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নেওয়ার। বারবার জিজ্ঞাসা করছিলো আমি বেলিডের মেম্বার কী না, আমি বললাম না। শুনে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন কেন বেলিডের সদস্য হওয়ার প্রয়োজন। তিনি আমার মধ্যে কী দেখেছিলেন জানি না, কিন্তু সেই দিনের সাক্ষাতের পর থেকে প্রায়ই আমাকে ফোন দিতেন। সময় পেলেই ফোন দিয়ে বলতেন আজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে দিয়ে যাবো, আপনি ফ্রি থাকলে একবার আপনার ওখানে চা খেয়ে যাবো। এভাবে রেজা ভাই প্রায় প্রতি রবিবারই আমার অফিসে আসতেন। সাথে থাকতো বেলিডের কোনো কাগজ বা কোনো পেশাজীবীর কোন তদ্বির সংক্রান্ত কাগজ। এগুলো হাতে দিয়ে প্রায়ই বলতো, চেষ্টা করে দেখেন তো যদি কিছু করা যায়। আপনি বড় অফিসে চাকুরি করেন কাউকে দিয়ে যদি বলানো যায়, এতে পেশা বা পেশাজীবীদের উপকার হবে। এই মহানুভব মানুষটি অন্য মানুষের তদ্বির করার জন্যে আসতেন কিন্তু কোনোদিন নিজের জন্যে আসেননি। এই ভাবেই তিনি আসতেন, আড্ডা দিতেন। এভাবেই রেজা ভাইয়ের সান্নিধ্য পাওয়া। আর এই সান্নিধ্য ও হৃদ্যতা যা ছিল আমৃত্যু।
ই-বুক এশিয়াতে অংশ নিতে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের গুরগাঁওতে যাচ্ছি। শুধু জানতাম বাংলাদেশ থেকে একটি টিম যাচ্ছে। কারা যাচ্ছে জানতাম না। আমি আর আমার অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক (প্রশাসন), বর্তমানে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, কবির বিন আনোয়ার স্যার এয়ারপোর্টে বোর্ডিং পাশের জন্যে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ করে দেখি আমাদের পাশে ড. রেজা ভাই। “কেমন আছেন মনিরুল? চিনতে পারছেন?” আমি বললাম, হ্যাঁ! চিনতে পারবো না কেন? আমি আমার বসের সাথে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। রেজা ভাই তাঁর ব্যক্তিগত কারিশমা দিয়ে স্যারের মন জয় করে নিলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে জানি না কী কথা হলো। তবে কবির স্যার যখন অন্য একটি বিষয় নিয়ে ব্যস্ত, তখন রেজা ভাই খুব কাছে বসে পিঠে হাত দিয়ে বললো, ‘‘খুব ভালো লাগলো মনিরুল। স্যার তো আপনার খুব প্রশংসা করলো। এটা ধরে রাখেন। যখন দেখি কোনো লাইব্রেরি পেশাজীবী ভালো করে তখন আমার খুব গর্ববোধ হয়। দেখেন স্যারকে বলে পেশাজীবীদের জন্য কিছু করা যায় নাকি।’’ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর বিমানে প্রথমে কলকাতা, তারপর কলকাতা থেকে দিল্লি। কোলকাতা এয়ারপোর্টে দিল্লিগামী ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছি। সাথে চলছে তিনজনের আড্ডা। জাতীয়তাবাদ, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি কোন কিছুই বাদ যাচ্ছে না। তবে ড. রেজা সবকিছুতেই কোনো না কোনোভাবে গ্রন্থাগার, গ্রন্থাগার পেশাজীবী আর বেলিডকে নিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, মানুষটির ধ্যান জ্ঞান যেন গ্রন্থাগার, গ্রন্থাগার পেশাজীবী আর বেলিড। পরে রেজা ভাই বলেছিলো, ‘‘দেখেন মনিরুল আমলারা তো আমাদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না, হয়তো জানতেই চায় না। তাই এক উচ্চ পদস্থ আমলার সাথে কথার ফাঁকে ফাঁকে গ্রন্থাগার, পেশাজীবীদের দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা ও তাদের সাফল্য তাঁর সামনে তুলে ধরছি।’’ রেজা ভাই যে এতো সফল ছিল তার প্রমাণ মিলে যখন কবির বিন আনোয়ার স্যার বেলিড আয়োজিত ইফতার পার্টিতে অংশগ্রহণ এবং স্কুল কলেজ লাইব্রেরিয়ানদের শিক্ষক পদমর্যদার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি পত্র ইস্যু করে দিয়েছিলেন। এই ছিল ড. রেজা ভাই, যিনি সব সময় শুধু গ্রন্থাগার পেশা, পেশাজীবী আর বেলিড নিয়ে ভাবতেন। তিনি ছিলেন গ্রন্থাগার পেশাজীবীদের আশ্রয় ও আশ্রম।
তখন সকাল আটটা হবে, দিল্লী থেকে ঢাকা ফেরার পথে কোলকাতা নিউমার্কেটের লিন্ডসলে স্ট্রিটের লিন্ডস হোটেলে উঠেছি, রুমের দরজায় শুনি হঠাৎ কে যেন নক করে। ভেবে পাচ্ছি না এতো সকালে কে আসবে আমার রুমে নক করছে। দরজা খুলেই দেখি পরিপাটি ড. রেজা ভাইকে। ‘‘কী ঘুম ভাঙ্গেনি, আপনার? তাড়াতাড়ি রেডি হন যাদবপুর যাবো। আপনাকে নিয়ে যাব। কাল যে বললাম, আপনাকে নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরতে যাব। আমার পুরনো ক্যাম্পাস, আমার খুব স্মৃতি বিজড়িত। আমি চাই সুন্দর এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আপনি ঘুরে দেখেন। এখানে গেলে জায়গাটার প্রেমে পড়ে যাবেন, আমি চাই জায়গাটার প্রেমে আপনি পড়েন। তাড়াতাড়ি রেডি হন তো।’’ চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে ফ্রেশ হতে শুরু করলাম। কাল রাতে পুরো নিউমার্কেট চষে বেরিয়েছি, তাই ক্লান্ত ছিলাম। ঘুম ভাল হয়নি। রিসেপশনে বসে দেখি রেজা ভাই পায়চারি করছেন। বললাম, খুবই দুঃখিত, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। স্বভাবলসুলভ একটা হাসি দিয়ে বললেন কোনো সমস্যা নেই। চলেন বের হওয়া যাক।
কোলকাতা শহরের বিখ্যাত এ্যাম্বাসিডর হলুদ রঙের ক্যাবে করে রওনা দিলাম যাদবপুরের উদ্দ্যেশে। হালকা বাতাস বইছে, আকাশে জৈষ্ঠ্য মাসের উত্তপ্ত সূর্য্য, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু ও সুনীলের লেখা বিভিন্ন বইয়ে পড়া কোলকাতার বিভিন্ন স্ট্রিট পার হচ্ছি, বিপরীত দিক থেকে আসছে ট্রাম, হলুদ এ্যাম্বাসিডর ক্যাব আর হালের সাদা রঙয়ের উবার, উলা ক্যাব। আর ড. রেজা ভাই শুরু করছেন, তাঁর কোলকাতা শহরের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন স্মৃতির রোমন্থন। তিনি বারবার প্রসঙ্গ তুলছেন পেশাজীবী হিসাবে থাকলে কেন পেশাজীবী সংগঠনে থাকাটা জরুরি। পিএইচডি ডিগ্রি কেন জরুরী। সাথে সেই সময় কত কষ্ট করে তিনি পিএইচডি শেষ করেছিলেন, কোলকাতার সেই সময় কেমন ছিল, এখন কেমন, কীভাবে ইন্টারনেটবিহীন সেই সময়ে ভাবী ও সবার সাথে যোগাযোগ করতেন ইত্যাদি। রেজা ভাইয়ের কথাগুলো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম সেই সময় তিনি কত কষ্ট করে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। তাঁর এই স্মৃতি রোমন্থন শুনতে শুনতেই আমরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গেছি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিখ্যাত ৩ নং গেট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলাম। গাড়িটি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার সাথে সাথে রেজা ভাই যেন আরো চনমনে হয়ে উঠলেন। মনে হচ্ছিল তিনি যেন এক স্মৃতির কৃষ্ণ গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া কোনো সময়কে আবার ফিরে পেয়েছেন। শুরু করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিময় গল্প। আমি গুণমগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনছি, আর আগ্রহ জন্মাচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, হাজার হোক অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী ড. অমর্ত্য সেনের বিশ্ববিদ্যালয়। পুরো ভারত বর্ষে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচিত করার পিছনে তাঁর অনেক অবদান। যদিও অমর্ত্যবাবুর নোবেল জয়ের আগে থেকেই ভারতবর্ষে যাদবপুর অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। গাড়িটা থামলো ঠিক লাইব্রেরি এন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স বিভাগের সামনে। বের হয়ে সিড়ি ধরে উঠার পরই চোখ পড়লো Golden Jubilee of Dept. Library and Information Science, Jadavpur University। প্রথমেই ঢুকলাম বিভাগের তৎকালীন প্রধান ড. সুনীল কুমার চ্যাটার্জি স্যারের রুমে। রেজা ভাই প্রায় ২০ বছর পর ডিপার্টমেন্টে এসেছেন কিন্তু সবার নাম তাঁর এখনো মুখস্ত। প্রফেসর চ্যাটার্জি, রেজা ভাইয়ের পূর্ব পরিচিত। কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি সবার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে থাকলেন।
তিনি যখন বিভাগে ঘুরছিলেন আর স্মৃতির পাতা রোমন্থন করছিলেন। বুঝেছিলাম বিভাগের সাথে তাঁর গভীর মিতালি যা কুড়িটি বছর পেরিয়ে গেলেও তার সাথে বিচ্ছেদ ঘটেনি। তিনি বললেন, এই বিভাগ আমার আশ্রয় ছিল, এখনো আছে। আমি চাই তুমিও এই আশ্রয়ে থিতু হয়ে পিএইচডি শেষ করো। তিনি বললেন তুমি হয়ত মনে করছ পিএইচ ডি করে কী হবে। একদিন এই জন্যেই আমাকে স্মরণ করবে। রেজা ভাইয়ের আগমনের খবর তখন বিভাগের অনেকেই জেনেছেন। সবাই আসছেন, কথা বলছেন আর আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। অসাধারণ সম্মোহন ক্ষমতা ছিল রেজা ভাইয়ের। সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন তিনি। তাঁর সাথে এই সফরের মাধ্যমেই সম্পর্ক আরো গভীর হয়, আমার সাথে হৃদ্যতা বাড়তে থাকে। তাঁর ব্যক্তিত্ব আমাকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছিলো। তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার আশ্রয়, আমার আশ্রম।
সেবারের ভারত সফর ছাড়াও ড. রেজা ভাইয়ের সাথে শ্রীলংকা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। ফলে তাঁর সাথে সম্পর্ক আরো গভীর থেকে গভীরতর হয়েছিল। তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক, শিক্ষক এবং একজন ভালো বন্ধু। তাঁর কাছে কোন আবদার করে পাইনি এমন হয়নি। সবকিছুতেই তাঁকে পাশে পেয়েছি। জানি না তাঁর পাশে থাকতে পেরেছি কি না। আমার ছোট্ট জীবনে ড. রেজা ভাইয়ের অবদান অনেক, যা কখনও ভুলার নয়, ভুলতেও চাই না। তাঁকে হৃদ মাঝারে রাখতে চাই, অনন্তকাল। তিনি যে আমার জীবনে, এক আশ্রয় ও আশ্রমের নাম।
লেখক: কনক মনিরুল ইসলাম লাইব্রেরিয়ান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়