মাহবুব হাসান
৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস-২০২২’ পালিত হয়েছে। মুজিববর্ষের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘সুবর্ণ জয়ন্তীর অঙ্গীকার, ডিজিটাল গ্রন্থাগার’। ২০২১ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার ঘরে ঘরে গ্রন্থাগার’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
এর ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উদযাপন করা হয়। সেই হিসেবে ২০২২ সাল “১ম জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস” উদযাপন করা হয়েছে। জনগণকে গ্রন্থাগারমুখী করা, পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি, মননশীল সমাজ গঠনের কেন্দ্রবিন্দু ও জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে লাইব্রেরির ভূমিকাকে দৃঢ় করাই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের লক্ষ্য। দেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রন্থাগার পেশাজীবিদের জন্য এই দিনটি সার্বজনীন উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই দেশের গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের জনক মোহাম্মদ সিদ্দিক খান (এমএস খান) কেও স্মরণীয় বরণীয় ভাবে বিবেচনা করা হয়।
গ্রন্থাগার পেশাজীবী, প্রকাশক ও পাঠকদের দীর্ঘদিনের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ৫ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বর্তমান সরকার। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। তাই এ দিনটিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস, হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী জেলা, উপজেলা পর্যায়ে এখন মোট গণগ্রন্থাগারের সংখ্যা ৭১টি। সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৯ হাজার। ৫৮ জেলায় মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ ৩৭ হাজার। সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারে প্রতিদিন ৩ হাজার ৩৬০ জন পাঠক আসেন। অন্যদিকে জেলা পাঠাগারগুলো দৈনিক ব্যবহার করছেন প্রায় ২ লাখ ৭৬ হাজার পাঠক।
দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান গ্রন্থাগার, এনজিও পরিচালিত গ্রন্থাগার ইত্যাদির মধ্যে একটি কার্যকর এবং ফলদায়ক সমন্বয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এরূপ সমন্বয়ের ফলে বাংলাদেশের গ্রন্থাগার সেবার মান ও কার্যকারিতা দু-ই আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্রন্থাগারগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে। গ্রন্থাগার হচ্ছে সভ্যতার বাহন। দিবসটি ঘিরে সারা দেশের গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার অঙ্গনগুলো নানামুখী কর্মকাণ্ডে মুখর থাকে। বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ৯০ লাখ ছাত্রছাত্রীকে বই পড়াচ্ছে। চার হাজার স্কুলে যেখানে কোনো লাইব্রেরি ছিল না, লাইব্রেরি করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এ ছাড়া আরও দুই হাজার বিদ্যালয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র লাইব্রেরি স্থাপন করেছে। ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি প্রায় তিন হাজার গণকেন্দ্র ও পাঁচ হাজার কিশোর-কিশোরী ক্লাবের মাধ্যমে লাইব্রেরি সেবা দিয়ে আসছে । দেশব্যাপী প্রায় ১৪ লাখ পাঠক-পাঠিকা তৈরি করেছে। এসব কেন্দ্রে বছরব্যাপী বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। জ্ঞান ও তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করছে ‘লাইব্রেরিজ আনলিমিটেড’ কর্মসূচি। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণার মাধ্যমে সরকারি–বেসরকারি সব পর্যায়ের গ্রন্থাগার–সংক্রান্ত কার্যাবলি আরও বেগবান হচ্ছে।
গ্রন্থাগারগুলোতে পাঠকের বয়স অনুযায়ী বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করা, চিত্তবিনোদেনর ব্যবস্থা করা ও বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য পাঠক ফোরাম, বই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। আগামী দিনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয় গণগ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ সমগ্র দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করবে। সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৯ হাজার। সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারে প্রতিদিন ৩ হাজার ৩৬০ জন পাঠক আসেন। গণগ্রন্থাগারের বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৯ হাজার। সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারে প্রতিদিন ৩ হাজার ৩৬০ জন পাঠক আসেন।
যে পরিবারে গ্রন্থাগার আছে, তা ওই পরিবারে এক ধরনের আলাদা জ্যোতি ছড়ায়। ওই পরিবারে অসামাজিক ও জঙ্গিবাদী কাজ হতে পারে না। প্রতিটি সচেতন পরিবারেরই উচিত একটি পারিবারিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা। শিশুদের বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করা। ছোট হলেও প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার চালু করা উচিত। প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার আছে কি না, থাকলে চালু আছে কি না, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা তা পড়েন কি না ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
দুঃখের বিষয়, অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক এবং অনেক অভিভাবক বলে থাকেন, বাইরের বই পড়ে সময় নষ্ট করার সময় নেই আমাদের শিক্ষার্থীদের। কলেজ পর্যায়েও বই পড়া, প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার স্থাপন ও সচল রাখার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের যদি আমরা সঠিক জ্ঞানের রাজ্যে নিয়ে যেতে পারি, বই পড়ার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পারি, তাহলে তাদের আত্মা পরিশুদ্ধ হবে, তারা জঙ্গিবাদে জড়াবে না, ইভ টিজিং করবে না, মাদকাসক্ত হবে না, হাতে হকিস্টিক আর পিস্তল নিয়ে প্রতিপক্ষকে তাড়া করবে না। বই পড়লে তারা আলোয় উদ্ভাসিত হবে, অন্যায় করবে না। তাদের মনের দিগন্ত প্রসারিত হবে। তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে বিশিষ্ট লেখক ও মহামানবদের সঙ্গে। আর সেটি সম্ভব বই পড়ার মাধ্যমে। বই পড়েই তারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে পারবে, দেশকে ভালোবাসতে শিখবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন গ্রন্থাগারবান্ধব সরকার দেশের জনগণকে আরও জ্ঞানমনস্ক করতে গ্রন্থাগারগুলোর সক্ষমতা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করে চলেছেন।
এ লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ছয় জেলায় লাইব্রেরি ভবন তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণ, অনলাইনে গণগ্রন্থাগারগুলোর ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন, দেশব্যাপী ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি পরিচালনা, ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিজ আনলিমিটেড শীর্ষক অনুমোদিত প্রকল্পের বাস্তবায়ন পুর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রন্থাগার সম্পর্কে বলেছেন, ‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়িয়া আছে। বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো।’ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন বই, বই এবং বই। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলেন, একটি বই একশটি বন্ধুর সমান, কিন্তু একজন ভালো বন্ধু, পুরো একটি লাইব্রেরির সমান। দেকার্তে বলেন, ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর সেরা মানুষদের সঙ্গে কথা বলা। অস্কার ওয়াইলড বলেন, একজন মানুষ ভবিষ্যতে কী হবেন, সেটি অন্য কিছু দিয়ে বোঝা না গেলেও তার পড়া বইয়ের ধরন দেখে, তা অনেকাংশেই বোঝা যায়। কবি এস এম শাহনূরের কথা ‘অন্ধ সে নয় যে চোখে দেখেনা, অন্ধ সেজন যে বই পড়ে না।’
গুণিজনদের এই উক্তিগুলো থেকে খুব সহজেই বোঝা যায়, উন্নত জাতি গঠনে গ্রন্থ এবং গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অপরিসীম।
এ বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারঘোষিত মুজিব বর্ষে দিবসটির তাৎপর্য আরও বেড়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর দর্শন, চিন্তাচেতনা, উদ্যোগ—সবই লিপিবদ্ধ আছে বইয়ের পাতায়। সেখান থেকেই নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে সবকিছু। যে জাতি তার ইতিহাস জানে না, তারা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। তাই সামনে এগোতে প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে, আর ইতিহাসের সেই গল্প লেখা আছে বইয়ে, আর সেই বই সংরক্ষিত আছে গ্রন্থাগারে। সুতরাং জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে গ্রন্থ, গ্রন্থাগার এবং গ্রন্থাগারিকতা শব্দগুলো একই সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে গুরুত্বের নিয়ে। আমরা জানি, যে জাতির গ্রন্থাগার যত সমৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত। তাই জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে, আমরা সুন্দর আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারব—এই হোক আমাদের সবার প্রত্যাশা।
লেখক: মাহবুব হাসান গ্রন্থাগার পেশাজীবি, ডকুমেন্টালিস্ট আহবায়ক, কসবা উপজেলা গ্রন্থাগার সমিতি