আনিকা তাবাচ্ছুম
৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর দেশব্যাপী দিবসটি ২০১৮ সাল থেকে পালন করে আসছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রতিবছর ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। দেশের জনগণের পাঠাভ্যাস সৃষ্টি এবং বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে, দেশব্যাপী এ দিবসটি উদ্যাপন করা হয়ে থাকে। ২০১৮ সাল হতে প্রতিবছর গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর প্রতিবছর গ্রন্থাগার দিবস কে সামনে রেখে একটি স্লোগান নির্ধারণ করে থাকে। ২০২২ সালের গ্রন্থাগার দিবস এর নির্ধারিত স্লোগান হচ্ছে -“সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার, ডিজিটাল গ্রন্থাগার“।
এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি অনন্য উদ্যোগ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার নির্দেশনায়, সহযোগিতায়, পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের গ্রন্থাগারগুলোতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। উন্নত বিশ্বের গ্রন্থাগার গুলো তাদের ব্যবহারকারীদের সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল গ্রন্থাগার সেবা প্রদান করে। ঘরে বসেই যে কেউ গ্রন্থাগার সেবা গ্রহণ করতে পারেন। গ্রন্থাগার ধারণাটি সূচনা লগ্ন থেকে এতটা সম্প্রসারিত ছিলনা। এর পিছনে রয়েছে বিস্তর ইতিহাস। পৃথিবীর ইতিহাসের মত গ্রন্থাগারের ইতিহাসও সুবিস্তৃত। জ্ঞান ও তথ্যসামগ্রী সংরক্ষণ ও বিকাশের প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রাচীনকাল থেকে গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু হয় এবং কালপরিক্রমায় ধীরে ধীরে এর বিকাশ ঘটে।
সভ্যতার আদি কাল থেকে মানুষ কোনো না কোনো রূপে জ্ঞানকে সংরক্ষণ করার জন্য উদগ্রীব ছিল। প্রাচীন কালে গ্রন্থাগারকে বলা হতো ‘প্রোটো লাইব্রেরী‘। ঐতিহাসিকদের মতে গ্রন্থাগারের সুত্রপাত হয়েছিল সংগৃহীত নথিসমূহকে সাজানোর মাধ্যমে। তখন গ্রন্থাগারগুলোতে সংরক্ষণ করা হত বিভিন্ন ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত এবং বাণিজ্যিক তথ্যাবলী। মূলত প্রাচীনকালে মন্দির গুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত তখনকার গ্রন্থাগার। ধর্মীয় তথ্য সংরক্ষণ ছিল তখনকার গ্রন্থাগার গুলোর প্রধান উদ্দেশ্য। মিশর, গ্রীস, রোম, ব্যাবিলন, প্যালেস্টাইন সভ্যতার প্রাচীন আদি নিদর্শন রূপে সংরক্ষিত হয়ে এসেছে সরকারি দলিল সমূহ। পরবর্তীকালে যদিও পারিবারিক ও ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহশালায় রাখা হতো। তবে সে সময় কাগজ ও কালির ব্যাবহার প্রচলিত ছিল না। পোড়ামাটির ফলক ও বিভিন্ন গাছের পাতা ছিল একমাত্র উপকরণ। মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় ৩০০০০ পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গিয়েছিল যা প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরাতন। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় পাওয়া গেয়েছিল ১৩০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্যাপিরাস স্ক্রোল। এই আদি নিদর্শনগুলোতে মূলত সমৃদ্ধ ছিল ধর্মীয় কাহিনী, পৌরাণিক উক্তি এবং ঐতিহাসিক ঘটনা দ্বারা। এই নিদর্শনগুলোর হাত ধরেই ধীরে ধীরে বিকাশিত হয়েছে গ্রন্থাগার ধারণাটি। যে গ্রন্থাগার গুলোর হাত ধরে কালের বিবর্তন ঘটেছে তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়ে যাক –
আশুরবানিপাল গ্রন্থাগার : এই গ্রন্থাগারটি খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা আশুরবানিপাল। আধুনিক ইরাকের নিনেভেতে অবস্থিত, সাইটটিতে বিষয়বস্তু অনুসারে সংগঠিত ছিল প্রায় ৩০০০০ কিউনিফর্ম ফলক। এর মধ্যে বেশিরভাগ আর্কাইভাল নথি, ধর্মীয় মন্ত্র এবং পণ্ডিত পাঠ্য। তবে এতে ৪০০০ বছরের পুরনো “গিলগামেশের মহাকাব্য” সহ বেশকিছু সাহিত্যকর্ম রয়েছে। বইপ্রেমী আশুরবানিপাল ব্যাবিলোনিয়া সহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে সাহিত্যকর্ম লুট করে তার গ্রন্থাগার সংগ্রহ সমৃদ্ধ করেন। পরবর্তীতে শত্রুপক্ষের হামলায় রাজ্যসহ সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এটি আবিষ্কার করে ধ্বংসাবশেষ দেখে অবাক হয়েছিলেন। উদ্ধারের পর ধ্বংসাবশেষ গুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বেশিরভাগ ফলক এখন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। মজার বিষয় হল, যদিও আশুরবানিপাল তার অনেক ফলক অন্যায় ভাবে লুট করার মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিলেন, তবুও তিনি সেসবকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন। শিলালিপিতে খোদাই করে লিখে দিয়েছেন কেউ যদি এই ফলক গুলো চুরি করে তবে দেবতারা তাকে ধ্বংস করে দিবেন। আনুমানিক ৬৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশুরবানিপালের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সাম্রাজ্য দখলের নিমিত্তে গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অনেক রাজ্য আলাদা হয়ে যায়। ৬১২ সালে শত্রুদের হাতে রাজধানী নিনেভের পতনের সাথে সাথে পরাক্রমশালী অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সমাপ্তি হয়। অ্যাসিরীয়দের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ থেকে শত্রুরা নিনেভকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। গ্রন্থাগারটি চাপা পড়ে সম্রাটের রাজকীয় প্রাসাদের জ্বলন্ত দেয়ালের নিচে।
পারগামাম গ্রন্থাগার : রাজা এট্রালাস ও তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে তুরস্কের পারগামামে এই গ্রন্থাগারটি নির্মিত হয়। এটি গ্রীক জ্ঞানের দেবী এথেনার প্রতি উৎসর্গীকৃত একটি মন্দির কমপ্লেক্সে অবস্থিত ছিল। মন্দিরে ৪ টি কক্ষ ছিল, এর মধ্যে তিনটি গ্রন্থাগারের জন্য বরাদ্দকৃত ও অবশিষ্ট কক্ষটি একাডেমিক সম্মেলনের জন্য সংরক্ষিত ছিল। এর সংগ্রহ সংখ্যা প্রায় ২০০০০০ ছিল। পারগামাম গ্রন্থাগার শেষ পর্যন্ত এতটাই বিখ্যাত হয়ে ওঠে যে এটিকে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের প্রতিদ্বন্দী হিসেবে ভাবা হতো। এমনকি কথিত আছে যে মিশরের টলেমাইক রাজবংশ প্যাপিরাস এর বৃদ্ধিকে ধীর করার আশায় পারগামামে প্যাপিরাসের চালান বন্ধ করে দিয়েছিল। সাধারণত পার্চমেন্ট ও ভেলাম এর তৈরি লাইব্রেরি উপকরণ এই পারগামাম লাইব্রেরিতে বেশি ছিল। পারগামাম লাইব্রেরির সংগ্রহগুলো বিষয় ভিত্তিকভাবে বিন্যাসিত ছিল এবং প্রতিটি গ্রন্থের সূচী তৈরি করা হয়েছিল। ফলে ব্যবহারকারিরা সহজে প্রয়োজনীয় উপকরণ খুঁজে পেত। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩ অব্দে রোমান সৈন্যবাহিনী পারগামাম জয় করেন এবং পারগামাম গ্রন্থাগারের সমস্ত উপকরণ লুট করে নিয়ে যায় মিশরে। তারা পারগামামের সেই সংগ্রহগুলো মিসরের রানী ক্লিওপেট্রাকে উপহার হিসাবে দান করেন। এই ভাবেই হারিয়ে যায় সেকালের বিখ্যাত পারগামাম লাইব্রেরি।
আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগার বা আলেকজান্দ্রিয়ার রাজ–গ্রন্থাগার : এটি ছিল প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগারগুলির একটি। এটি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মিশরের টলেমিক রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গ্রন্থাগারটি গড়ে উঠেছিল। এই গ্রন্থাগার প্রকৃতপক্ষে ছিল মিউজিয়াম নামে এক বৃহত্তর গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অংশ। এখানে প্রাচীন বিশ্বের বহু বিশিষ্ট দার্শনিক পড়াশোনা করেছিলেন। এঁরা হলেন ইউক্রিড, আর্কিমিডিস, ইরাটোস্থিনিস ,হেরোফিলাস, এরাসিস্ট্রাটাস, হিপ্পারাকাস, এডেসিয়া, পাপ্পাস, থেওন, হাইপেশিয়া, আরিস্টারকাস অফ সামোস ও সেন্ট ক্যাথারিন। এই গ্রন্থাগার ছিল মিশরের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার প্রতীক। ৩০৯-২৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা টলেমি দ্বিতীয় ফিলাডেলফাসের রাজত্বকালে গ্রন্থাগারে ৫০০,০০০-এরও বেশি স্ক্রোল ছিল বলে ধারণা করা হয়। কথিত আছে বিবাহের উপহার হিসেবে পারগামাম গ্রন্থাগারের ২০০,০০০ স্ক্রোল মার্ক অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রাকে উপহার দিয়েছিলেন। সারা পৃথিবী থেকে বই ধার করে তার অনুলিপি তৈরি করা ও সেই বই গ্রন্থাগারে নিয়ে আসার জন্য এই গ্রন্থাগারে কর্মচারী নিয়োগ করা হত। অধিকাংশ বইই রাখা হয় প্যাপিরাস স্ক্রোলের আকারে। তবে ঠিক কতগুলি স্ক্রোল এই গ্রন্থাগারে রক্ষিত ছিল তা জানা যায় নি। শত্রুদের হামলায় গ্রন্থাগার পুড়ে গিয়েছিল। যার ফলে বহু স্ক্রোল ও বই চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়।
আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগারের অগ্নিকাণ্ডকে সাংস্কৃতিক জ্ঞান ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কে এই অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছিলেন তা নিয়েও মতান্তর রয়েছে। এই ধ্বংস নিয়ে একটি জনশ্রুতি হল, বহু বছর ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে এই গ্রন্থাগার বিনষ্ট হয়। সম্ভবত ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজারের মিশর আক্রমণের সময়, ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে আরেলিয়ান আক্রমণের সময়, ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দে কপটিক পোপ থেওফিলাসের নির্দেশে এবং ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে মিশরে মুসলমান আক্রমণের সময় সংঘটিত পৃথক পৃথক অগ্নিকাণ্ডে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়।
হাউজ অফ ওয়াইজডম বা গ্রান্ড লাইব্রেরি অফ বাগদাদ : ইরাকের বাগদাদ শহর একসময় বিশ্বের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র ছিল। আব্বাসীয়দের শাসনামলে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্থানটি তখন গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং দর্শনের উপর লিখিত ফার্সি, ভারতীয় এবং গ্রীক পাণ্ডুলিপিতে পরিপূর্ণ ছিল। একটি বিশাল কক্ষের চারদিকে পান্ডুলিপি গুলো সুসজ্জিত অবস্থায় ছিল। বইগুলি মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ পণ্ডিতদের কাছে একটি প্রাকৃতিক আকর্ষণ হিসাবে সমাদৃত ছিল। তারা এর পান্ডুলিপি গুলোকে অধ্যয়ন করে সেগুলিকে আরবীতে অনুবাদের কাজ করতেন। গ্রন্থাগার ব্যবহারকারী পন্ডিতদের মধ্যে গণিতবিদ আল-খাওয়ারিজমি, পলিম্যাথ চিন্তাবিদ আল-কিন্দি অন্যতম ছিলেন। হাউস অফ উইজডম কয়েকশ বছর ধরে ইসলামিক বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক স্নায়ু কেন্দ্র হিসাবে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে ১২৫৮ সালে মঙ্গোলরা বাগদাদকে দখল করার পর গ্রন্থাগারটির সাথে একটি ভয়াবহ অন্যায় ঘটে। কথিত আছে এত বেশি বই টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল যে বইয়ের পাতার রঙে নদীর পানি কালো হয়ে গিয়েছিল।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, হিস্ট্রি ডট কম, গণগ্রন্থাগার ওয়েবসাইট
কোলাজ ছবি-ইন্টারনেট