আনিকা তাবাচ্ছুম
গ্রন্থাগার শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দেখা যায় (গ্রন্থ+আগার)। শাব্দিক অর্থের যে স্থানে গ্রন্থ সংরক্ষণ করা হয় তাকে বলা হয় গ্রন্থাগার। একটি গ্রন্থাগার বলতে আমরা বুঝি যেখানে বই সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়। সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হিসেবেও গ্রন্থাগার শব্দটি পরিচিত। গ্রন্থাগারের প্রাণ হলো বই আর সে প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখার কাজ হলো পাঠকদের। গ্রন্থাগারে যে কেবল সাহিত্যের বই থাকে এ ধারনাটি যেমন ভুল তেমনি পাঠকরা যে গ্রন্থাগারে কেবল গল্পের বই পড়তে যায় তা কিন্তু নয়! গ্রন্থাগারে সাহিত্যের বইয়ের পাশাপাশি ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, গবেষণাধর্মী বই থাকে। সাধারণ পাঠকদের পাশাপাশি ছাত্র, শিক্ষক, উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশী, চাকরি প্রত্যাশী ও গবেষকরা গ্রন্থাগারে গিয়ে গ্রন্থাগার সেবা গ্রহণ করে থাকেন। গ্রন্থাগারের সাথে অন্যান্য পাঠকদের যে সম্পর্ক তার চেয়েও গবেষকদের সম্পর্ক কোন অংশে কম গভীর নয় বলে মনে করা হয়।
এ কথার মর্মার্থ বিশ্লেষণের জন্য প্রথমে গবেষণা নিয়ে একটু সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা প্রয়োজন। গবেষণা হলো একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক অনুসন্ধিৎসু প্রক্রিয়া। এটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সৃষ্টির একটি স্বীকৃত ও অনবদ্য পন্থায় অপেক্ষাকৃত উদ্দেশ্যভিত্তিক, পর্যবেক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন বিষয় জানতে চেষ্টা করে বা পুরনো জ্ঞাত বিষয়কে যাচাই করে এবং
এদের মধ্যকার পারস্পরিক ব্যবধানকে ঘোচাতে সাহায্য করে। গবেষণা হচ্ছে জ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন কোন কিছু যোগ করা। তবে কোন বিষয়ে গবেষণা করার জন্য প্রথমে সুনির্দিষ্ট ধাপ বা পর্যায় অতিক্রম করে অগ্রসর হতে হয়। যেমন –
- ১. গবেষণার বিষয় চিহ্নিতকরণ
- ২. প্রাসঙ্গিক বই পত্রের পর্যালোচনা
- ৩. গবেষণার নকশা প্রস্তুতকরণ
- ৪. তথ্য সংগ্রহকরণ
- ৫. তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিশ্লেষণ
- ৬. ফলাফল উপস্থাপন বা প্রতিবেদন প্রস্তুতকরণ।
এ ধাপগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই গ্রন্থাগারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যবহার রয়েছে। একজন ব্যক্তি যদি কোন বিষয়ে গবেষণার করতে চায় তাহলে তা শুরু করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আপনার বিষয়, আপনার গবেষণার বিষয় এবং মৌলিক পদ্ধতির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী তৈরি হয়ে গেলে নিকটস্থ গ্রন্থাগার বা অনলাইন গ্রন্থাগারের ডাটাবেসের শরণাপন্ন হওয়া । এছাড়াও গবেষণার বিষয় নির্বাচন করার জন্য অন্যান্য গবেষণা সম্পর্কে জানা জরুরি। আর এ কাজটি করতে হলে একজন ব্যক্তিকে গ্রন্থাগার পরিদর্শন করতে হবে। এ কাজটির মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার গবেষণার বিষয় নির্বাচন করতে সক্ষম হন ও একই সাথে সমসময়িক অনেক গুলো গবেষণা পত্র পর্যালোচনার সুযোগ পেয়ে থাকেন।
একটি সফল গবেষণার জন্য প্রয়োজন সঠিক তথ্য সংগ্রহ। প্রকৃতপক্ষে সঠিক তথ্য সংগ্রহে হল গবেষণার মূল ভিত্তি। আর এই কাজটি করার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী স্থান হল গ্রন্থাগার।
গবেষণায় গ্রন্থাগারের ভূমিকা অন্যান্য একাডেমিক ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের ভূমিকার মতোই তাৎপর্যপূর্ণ। গ্রন্থাগারে বই, জার্নাল, ম্যাগাজিন, নিবন্ধ এবং গ্রন্থপঞ্জি সহ অনেক রকমের তথ্য সম্পদ রয়েছে। এছাড়াও গ্রন্থাগারগুলো গবেষণার জন্য নির্দিষ্ট স্থান ও চমৎকার পরিবেশ প্রদান করে। গ্রন্থাগারকর্মীরা এমন ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে থাকে যাতে একজন গবেষকের প্রয়োজন হতে পারে এমন তথ্য সনাক্ত করতে সর্বদা সাহায্য করতে সচেষ্ট থাকে। এছাড়াও, বেশিরভাগ গ্রন্থাগারে ডিজিটালাইজড তথ্যসেবা চালু রয়েছে। বর্তমানে ডিজিটাল গ্রন্থাগার ব্যবহার করে গবেষণার কার্যকর পরিচালনা করা হয় এবং এতে করে গবেষকরা অধিকতর অপকৃত হয়ে থাকেন। একজন গবেষক ঘরে বসেই গ্রন্থাগার সেবা গ্রহন করতে পারে। এতে করে একদিকে যেমন কম সময় ব্যয় হয় তেমনি কাজও অধিক সহজতর হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে গবেষণা কাজের জন্য গ্রন্থাগার নামক প্রতিষ্ঠানটি সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে।
গবেষণা কাজে গ্রন্থাগার সেবা গ্রহন করেছেন ও উপকৃত হয়েছেন এমন কিছু শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হলো –
মোঃ রাকিবুল হাসান রিফাত খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তিনি তার গবেষণাকর্ম পরিচালনার অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে গিয়ে বলেন, ” ভার্সিটির সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ডিজিটাল হবার কারণে সেখানে বই, জার্নাল পেপার, পুরাতন থিসিস পেপার (অনলাইন এবং প্রিন্টেড কপি) এগুলো আর্কাইভে যথাযথভাবে সংগৃহীত ছিলো।
ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরীর চাইতেও বর্তমানে অনলাইন লাইব্রেরীতে খুব দ্রুত পাওয়া যায়। তবে কিছু বই, যেগুলো খুব মেজর না হলেও ছোটখাটো বিষয় দেখতে সহায়তা করে, তা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর আর্কাইভে পাওয়া যায়। যেটা আমাকে আমার রিসার্চের বিভিন্ন সেকেন্ডারী ডাটা দেখার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে।”
সিরাজুম মুনিরা জার্মানির Ruhr university bochum এর শিক্ষার্থী। তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন ”গবেষণার সময় অনেক থিওরেটিকাল টার্মের ব্যাখ্যা বিশদভাবে জানার জন্য একের অধিক বইয়ের প্রয়োজন হয়। আর এখন ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় ই-লাইব্রেরী বেশ জনপ্রিয় এবং কার্যকরী। কারন অনেকের পক্ষে একের অধিক বই কিনে পড়াও সম্ভব নয়। তাই ই লাইব্রেরী খুবই প্রয়োজনীয়। এ ছাড়া যে কোন রিসার্চ কাজ করার আগে বা পেপার লেখার আগে সেই কাজের ব্যাকগ্রাউন্ড বা ওই রিলেটেড আরো কী কী রিসার্চ হয়েছে তা সহজে জানার জন্য, যে কোন রিসার্চ পেপার সহজে বিনামুল্যে পড়ার পারা জন্য একটি রিসোর্সফুল লাইব্রেরী খুবই উপকারী।”
উল্লেখিত গবেষকদের মধ্যে প্রত্যেকেই তাদের গবেষণা কাজে গ্রন্থাগার সেবা গ্রহন করেছেন। তবে বর্তমানে প্রথাগত গ্রন্থাগারের তুলোনায় অনলাইন গ্রন্থাগারের জনপ্রিয়তা অধিক। এর পেছনে যথেষ্ট কারনও রয়েছে। যেমন ঘরে বসেই গ্রন্থাগার সেবা গ্রহন করা যায়, দিন রাত ২৪ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন সেবা পাওয়া যায়, সহজেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের বাইরের গ্রন্থাগার গুলোতে প্রবেশ করে বিভিন্ন সেবা গ্রহন করা যায়।
গবেষকদের প্রয়োজন মেটাতে বিশেষ গ্রন্থাগার, একাডেমিক গ্রন্থাগার ও অন্যান্য সাধারণ গ্রন্থাগারগুলো সর্বদা সেবা প্রদান করতে সচেষ্ট থাকে। যদিও কিছু আর্থিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারনে গ্রন্থাগার গুলোতে সেবা প্রদান ব্যহত হয়। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় একটি দেশের গবেষণা খাতে উন্নয়নের পেছনে গ্রন্থাগারগুলোর অবদান অনস্বীকার্য!
- রেফারেন্স : সামাজিক গবেষণা, ড. মোঃ নুরুল ইসলাম।
- গ্রাফিক্সঃ ফ্রি-পিক
গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিভাগ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, লালমাটিয়া, ঢাকা।