একটি উপন্যাসের সার্থকতার সিংহভাগ নির্ভর করে চরিত্রবিন্যাসের ওপর। অপেক্ষা-তেও ঠিক তাই হয়েছে। ছোট্ট সুপ্রভার চরিত্রটিও এখানে অনেক চরিত্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। স্বাভাবিক গৃহিণী সুরাইয়ার এমন বদলে যাওয়া, সুপ্রভার পরিণতি, জামিলুর রহমানের ভালোবাসা, ইমনের বেড়ে ওঠা, ছোট চাচার জীবনপথ সব মিলিয়ে অতি সাধারণ মধ্যবিত্তের হাসি-আহ্লাদ-দুঃখ-বেদনার গল্পেই অসাধারণ হয়ে উঠেছে উপন্যাসটি। এই উপন্যাসের এক জায়গায় লেখক বলেছেন, ‘মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপেক্ষা নামের ব্যাপারটি খুব প্রয়োজন। অপেক্ষা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার টনিক।’
ইশরাত জাহান:
হুট করেই একদিন হারিয়ে গেলেন হাসানুজ্জামান। অনাগত সন্তানের আগমনবার্তা তার আর শোনা হলো না। মানুষের জীবন কী চক্রের মতো? ঘুরতে ঘুরতে আগের ফেলে যাওয়া পথে আবার এসে থমকে যায়? পত্রিকায় কতশত নিখোঁজ সংবাদ পড়ি আমরা। মাঝে মাঝে রাস্তায় শুনি মাইকিং বা বাসের পেছনে, দেয়ালে দেখি ছাপা পোস্টার। এসব দেখে বড়জোর জিভ দিয়ে টাকরায় একধরণের আওয়াজ করে আমরা দুঃখ প্রকাশের চেষ্টা করি। কিন্তু যে পরিবারের কেউ এমনভাবে হারিয়ে যায়, সে পরিবারের মানুষের সামাজিক, আর্থিক, মানসিক অবস্থা কী হয়, সেটা আমরা কল্পনায়ও আনতে পারি না। চাইলেই কী জীবন থেকে হুট করে কাউকে মুছে ফেলা যায়? খুব ভালোবাসার, খুব কাছের কারো নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াটা কী মেনে নেয়া এতো সহজ? না, সহজ নয়। সহজ নয় বলেই মেনে নিতে পারেননি হাসানুজ্জামানের স্ত্রী সুরাইয়া। পুরো পৃথিবী তার কাছে ধীরে ধীরে আবছা হয়ে আসতে থাকে। নানা টানাপোড়েনের মাঝে তার মনে কেবল জ্বলে থাকে একটি আশা, একজনের ‘অপেক্ষা’। স্বামীর প্রতি অনিঃশেষ ভালোবাসা থেকে মনের গভীরে তার গেঁথে গিয়েছিলো, হাসানুজ্জামান মারা যাননি। তিনি একদিন ঠিকই ফিরে আসবেন। গল্পের শুরুতেই দেখা যায়, স্বামী হাসানুজ্জামান ও ছেলে ইমনকে নিয়ে সুরাইয়ার সুখের সংসার। সেই সংসারে নতুন এক অতিথি আসতে চলেছে। এই সংবাদ দেওয়ার জন্য স্বামীর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল স্ত্রী সুরাইয়া। কিন্তু সেদিন অফিস থেকে আর বাসায় ফিরে আসে না হাসানুজ্জামান। থানা, হাসপাতাল সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খোঁজ চালানো হয় কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। ‘অপেক্ষা’র শুরু সেদিন থেকেই। দুই সন্তান ইমন ও সুপ্রভাকে নিয়ে সুরাইয়া তার বড়ভাই জামিলুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানে গিয়ে সে নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নেয়, একটা ঘরে সারাক্ষণ নিজেকে বন্দী রেখে স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষা করতে করতে তিনি ধীরে ধীরে বাস্তব জগত থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন, তার বেঁচে থাকার সমস্তটুকুই যেন তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করার মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। জগতের সব ব্যাপারেই সুরাইয়ার বিতৃষ্ণা চলে আসে।
ব্যক্তিগত হতাশার কারণে তার মেজাজটাও হয়ে যায় তিরিক্ষি। নিজের দুই সন্তান ইমন ও সুপ্রভার সাথেও তার আচরণ দিনদিন অসহনীয় হয়ে যেতে থাকে। সুরাইয়ার অপেক্ষাকে কেন্দ্র করেই পারিপার্শ্বিক জীবনের নানা ঘটনাকে উপজীব্য করে এগিয়ে যেতে থাকে উপন্যাসটি। মূল গল্পের সাথে তাল রেখে অন্যান্য পার্শ্বগল্পও সমান্তরালে এগিয়েছে ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসে। গল্পের নায়ক ইমন ও নায়িকা মিতুর অন্যরকম আবেগটি তাই বেশ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ইমনের কাছে পাঠানো মিতুর উড়ো প্রেমের চিঠি কিংবা বেবিটেক্সিতে বসে ভবিষ্যতে ইমনকে বিয়ে করার কথা বলে হকচকিয়ে দেওয়ার সংলাপগুলো পড়ে পুরো উপন্যাসের করুণ সুরের মাঝেও পাঠকরা একটু হেসে ফেলবেন। উপন্যাসে সুরাইয়ার ভাই জামিলুর রহমানের পরিবারের গল্পটা কাহিনীর প্রয়োজনেই উঠে এসেছে। কর্তা শুধুমাত্র নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সেই পরিবারের গতিপথ ঠিক কতটা এলোমেলো হতে পারে তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি ছিল এই পরিবার। একটি উপন্যাসের সার্থকতার সিংহভাগ নির্ভর করে চরিত্রবিন্যাসের ওপর। অপেক্ষা-তেও ঠিক তাই হয়েছে। ছোট্ট সুপ্রভার চরিত্রটিও এখানে অনেক চরিত্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। স্বাভাবিক গৃহিণী সুরাইয়ার এমন বদলে যাওয়া, সুপ্রভার পরিণতি, জামিলুর রহমানের ভালোবাসা, ইমনের বেড়ে ওঠা, ছোট চাচার জীবনপথ সব মিলিয়ে অতি সাধারণ মধ্যবিত্তের হাসি-আহ্লাদ-দুঃখ-বেদনার গল্পেই অসাধারণ হয়ে উঠেছে উপন্যাসটি। এই উপন্যাসের এক জায়গায় লেখক বলেছেন, ‘মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপেক্ষা নামের ব্যাপারটি খুব প্রয়োজন। অপেক্ষা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার টনিক।’ আবার আরেক জায়গায় বলেছেন, ‘প্রকৃতি যাকে দেবার তাকে উজাড় করেই দেয়। যাকে দেবার না তাকে কিছুই দেয় না।’ বেঁচে থাকার টনিক ‘অপেক্ষা’ নিয়ে সুরাইয়া বেঁচে থাকতে পেরেছিলো সত্য। কিন্তু প্রকৃতি তাকে উজাড় করে অপেক্ষার ফল দিয়েছিলো কি না, সে ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদ বরাবরের মতোই একটা ধোঁয়াশা রেখেছেন। সুরাইয়ার খুব আনন্দ বা আশাভঙ্গের বেদনার সিদ্ধান্তটি পাঠকদের হাতেই হয়তো ছেড়ে দিয়েছেন তিনি!
ইশরাত জাহান
- বিএ (সম্মান), চতুর্থ বর্ষ,
- তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ,
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।