“এতোদিনের ছুটিতে স্টুডেন্টদের অবস্থা একেবারেই শেষ, পড়াশোনা তো হচ্ছেই না, সারাদিন রাত অনলাইন।” আমার একজন সিনিয়র আক্ষেপ করে বলেছিলেন কিছুদিন আগে। আসলেই কি ছাত্রছাত্রীরা তাদের মূল্যবান সময় নস্ট করে ফেলছে? বেড়ে গিয়েছে অনলাইন আসক্তি? আমাদের হয়তো জানা’তে বড় ধরনের একটা গ্যাপ তৈরী হয়ে গিয়েছে! সাথে বিরুপ ধারনা! তাই সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করতে পারছি না।
ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকেই এই সময়টা এত সুন্দরভাবে কাজে লাগিয়েছে যা আমরা জানি না। তাদের মধ্যে অসাধারণ ৬ জন স্টুডেন্ট এর সাথে পরিচিত হয়ে আসি চলুন এবং দেখে আসি তাদের করোনাকালীন কর্মকাণ্ড।
আফরিদা আহমেদ হৃদি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সুন্দরী মেয়েরা নাকি মাকাল ফলের মতো। খুব বেশি গুন থাকে না। কথাটা যে একদম ডাহা মিথ্যা কথা, তা হৃদি কে দেখলেই বোঝা যায়। রূপবতী এই মেয়েটাকে দেখেছি ভার্সিটিতে প্রথম বর্ষ থেকেই টপার। বই পড়তে পছন্দ করে। ঘুরতে পছন্দ করে। দেশের মধ্যে তো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর গল্প আছেই সাথে অনেক সময় দেখা যায় দেশের বাইরেও ট্যুর দিয়ে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ক্লাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। হৃদি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে মজার মজার রান্না করতে। আর এরকম ভালো লাগা থেকেই অনলাইন বিজনেস শুরু। করোনার দীর্ঘ সময়ের ছুটি যেন সেই ইচ্ছেটাকে বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে ভীষণভাবে সহায়তা করছে। হৃদির মজার মজার রান্না আর চমৎকার রিভিউ দেখতে চাইলে নিচের লিংকে গিয়ে একবার ঢু মেরে আসতে পারেন।
আর হ্যা, ঢাকায় যারা আছেন তারা মাঝে মাঝে অর্ডার করতেও ভুলবেন না। প্রিয়জনের জন্মদিন, ফ্যামিলি আড্ডা কিংবা বন্ধুকে সারপ্রাইজ দেবার ক্ষেত্রে এই সুস্বাদু খাবারগুলো আনন্দের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
লিংক – https://www.facebook.com/creamycheesygoods/
রাফি বিন শাহাদাত সুপান্থ, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
বই পড়তে বিরক্ত লাগে? ধৈর্য্য হয় না? কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করে? কি করবেন তখন? চট করে ছোট্ট একটা রিভিউ পড়ে ফেলুন। নানা ঝামেলার কারনে ক্লাস চলছে না ঠিক মতো। তাই বলে কি বাসায় বন্দী থেকে সময়গুলো নষ্ট করা যায়? মোটেইনা। বিভিন্ন রকমের অনলাইন কোর্সের সাথে সাথে সুপান্থ তৈরী করে ফেলেছে একটা ব্লগ সাইট।
তাও আবার নিজে নিজে শুধুমাত্র ইউটিউবের সাহায্য নিয়ে। সেখানে সে শুধু বুক রিভিউই নয়, নিজের লেখা ছোট ছোট গল্প, থ্রিলার, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় আপলোড করে থাকে। সময় করে একবার ব্লগ সাইটে ঘুরে আসতে পারেন। ছেলেটা সবেমাত্র সেকেন্ড ইয়ারে পড়লেও লেখার হাত কিন্তু অসাধারণ। লেখা পড়ার আগেই যে বিষয়টিতে চমৎকৃত হবেন তা হচ্ছে এর নিজের হাতে তৈরী ব্লগ সাইটটির সৌন্দর্য দেখে।
একটা কথা না বললেই নয়। মানুষের যেদিকে প্রতিভা এবং ভালোলাগা থাকে সেদিকটা একটু চর্চা করলে অনেক ভালো ফল পাওয়া যায়। সুপান্থ সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিল্যান্সিং একটা কোম্পানি থেকে content writer হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে এবং সেখানে কাজ করার জন্য যে ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টেস্ট দিতে হয়, তাতেও খুব ভালো রেজাল্ট করেছে।
স্টুডেন্ট লাইফে এরকম ছোট ছোট কাজগুলো থেকেই জীবনে অনেক বড় কিছু করে ফেলা যায়।
লিংক – https://rbssupantho.blogspot.com/?m=1
রাকিবুল আলম, বেইবু গাল্ফ ইউনিভার্সিটি, চায়না
দেশের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ সেই মার্চ মাস থেকে। দূর্ভোগ পোহাচ্ছে কি শুধু দেশের শিক্ষার্থীরা? যারা বাইরের দেশগুলোতে পড়াশোনা করে, তাদের জীবনও চলছে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে। ফ্লাইট কবে শুরু হবে, ক্যাম্পাসে গিয়ে তারা আবার কবে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে তার নেই কোনো নিশ্চয়তা।
তাহলে কি? হতাশায় মুখ গোমরা করে বসে থাকতে হবে? চাইলেই এই দীর্ঘ ছুটিটাকে অন্যরকম ভাবে কাজে লাগানো যায়। যেমন রাকিব ইন্টার্ন হিসেবে জয়েন করেছে Guandong Caigle Science & Technology Company Ltd এ।
এটি বাংলাদেশে অবস্থিত একটি চাইনিজ কোম্পানি। সে চীনে পড়াশোনা করছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগে। ফাইনাল ইয়ারে তাদের মেজর কোর্স হিসেবে ইন্টার্নশিপ করতে হয়। এই সুযোগে ও নিজের ইউনিভার্সিটি থেকে অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশেই ইন্টার্নশিপ করে ফেলেছে। এতে করে যেমন ভারি হচ্ছে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি, তেমনি প্রতিমাসে ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে নিজের হাত খরচের টাকার।
বুদ্ধি থাকলে খুব খারাপ সময়ের মধ্যেও ভালো কিছু করা যায়। তাই না?
নাজিবুর রহমান নাজিম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছয় মাসের ছুটিতে ১৫০+ বই পড়া এবং নিজেকে ডেভলপ করার জন্য অসংখ্য কোর্স করে ফেলা যায়। বিশ্বাস হয়? এই ছেলেটা সেই অসম্ভব কে সম্ভব করে ফেলছে। সে শুধু নিজে পড়তে পছন্দ করে তা নয়। অন্যদের বই পড়ানোর জন্যও একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। মানুষকে বই পড়তে উৎসাহী করে তোলা এবং তাদের হাতে বই তুলে দেয়া যে প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য। সে স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে ইনফরমেশন সাইন্টিস্ট হবে। সাথে এটাও স্বপ্ন দেখে মানুষ অকাজে সময় নষ্ট না করে বই পড়বে। প্রতিটি বাড়িতেই তৈরী হবে একটি করে লাইব্রেরি এবং অনেকগুলো আলোকিত মানুষ। সৃষ্টিকর্তা নাজিমের এই সৎ ইচ্ছে পূরণ করুক।
শাহেদুর রহমান রনি, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মানুষকে সাহায্য করার ইচ্ছা থাকলে যেকোনো পরিস্থিতিতেই করা যায়। হ্যা বলছিলাম সাহায্য প্রসঙ্গে। করোনা মহামারীতে যখন পুরো দেশ স্থবির, বাইরে বের হওয়ার কোনো উপায় ছিলো না, তখনও এই ছেলেটা কাজ করেছে মানুষের কাছে বই পৌছে দেওয়া নিয়ে। গড়ে তুলেছে নিজের বন্ধু লাইব্রেরী। এটি শুধু একটি বই এর দোকানই নয়, এটি বিস্তার লাভ করেছে অনলাইনেও। জব রিলেটেড, মোটিভেশনাল, সাহিত্য, ছোটদের সহ সব রকমের বই দ্রুততম সময়ে সারাদেশের মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার চেষ্টা করেছে সে।
দায়িত্ব, নিষ্ঠা এবং কাজের প্রতি ভালোবাসার জন্য মানুষের সাড়াও পেয়েছে খুব ভালোভাবে। তাই হয়তো বই এর পাশাপাশি নতুন করে স্টেশনারী এবং ইলেকট্রনিক জিনিসপত্রও যোগ হতে যাচ্ছে রনির ব্যবসায়।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেই কিন্তু মানুষ কাঠখোট্টা স্বভাবের হয়না। যেমন রনি মানুষকে ভালোবাসতে এবং সাহায্য করতে খুব পছন্দ করে। ভালো লাগার তালিকায় আরো রয়েছে লেখালেখি, এবং ভ্রমন। সুযোগ পেলেই সে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছোটাছুটি করে বেড়ায়।
রেবেকা উর্মি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভালো ছবি আঁকতে পারেন? গান গাইতে পারেন? সুন্দর কন্ঠ? কিন্তু এই প্রতিভা গুলো কাজে লাগানোর সময় বা সুযোগ কতটুকুই বা পাওয়া যেত ক্লাস চলাকালীন সময়ে। এই বিশাল বড় ছুটিটা যে সবার জন্য অনেক খারাপ অবস্থা তৈরী করেছে তা কিন্তু নয়। কারো কারো কাছে ধরা দিয়েছে আশীর্বাদ হয়ে।
উর্মি চারুকলার স্টুডেন্ট না হলেও খুব সুন্দর আঁকতে পারে। একের পর এক অসাধারণ ছবি একেই চলেছে। সাথে গান চর্চাটাও থেমে নেই। যথেস্ট সময় এখন হাতে। সবথেকে বড় যে কাজটা করছে তা হচ্ছে একটা অডিও বুক ক্রিয়েটিং প্রজেক্ট। নিজের কন্ঠে গল্প শোনায় শ্রোতাদের। যা আপলোড করা হয় একটি ইউটিউব চ্যানেলে। কেউ শুনতে চাইলে চ্যানেলটিতে একবার ঘুরে আসতে পারেন। খরাপ সময়ের দিকে মনোযোগ না দিয়ে গল্প শুনুন, নিজেকে ভালো রাখুন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন।
লিংক – https://youtu.be/iDc34Q8MRMk
প্রতিবেদক : জান্নাতুল আরা লিজা ও আরেফিন আলভী
- শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।