কনক মনিরুল ইসলাম:
বই হলো মনের খাদ্য। আর গ্রন্থাগার হলো সেই মনের খাদ্যের ভান্ডার। ভালো বই মানুষের মনের সুকুমারবৃত্তিগুলো জাগিয়ে তোলে। একটি সুন্দর সমাজ এবং একটি গ্রন্থাগার একে অন্যের পরিপূরক। গ্রন্থাগারকে পাঠকের ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে গ্রন্থাগারিকের ভূমিকা সর্বাগ্রে। আর তাই গ্রন্থাগারিকতা একটি মহান পেশা। গ্রন্থাগার সামগ্রীকে ব্যবহার উপযোগী করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করার জন্য প্রায় সারা বছরই গ্রন্থাগার পেশাজীবিদের নিরলস পরিশ্রম করতে হয়। সহজাতভাবেই যে সকল মানুষ গ্রন্থাগার পেশার সাথে জড়িত থেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আমাদের মননশীলতাকে জ্বালিয়ে রাখেন তাঁরা আমাদের শ্রদ্ধার দাবীদার। কিন্তু আজও গ্রন্থাগারিকতা পেশার পেশাগত মর্যাদা, সামাজিক মর্যাদা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়নি। এমনকি সুন্দরভাবে জীবন ধারনের জন্য অন্যান্য পেশাজীবিদের মত বেতন স্কেলও পায়নি।
একটি দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের কথা আলোচিত হলে সর্বপ্রথম বই ও লাইব্রেরির কথা চলে আসে। কিন্তু বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি কিভাবে হবে ও গ্রন্থাগার উন্নয়ন কিভাবে হবে সেকথা কখনও আলোচিত হয়না। একথা সবাই বিশ্বাস করে একটি জাতির মেধা, মন, মনন ও মানসিক বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গ্রন্থাগার। অথচ বই ও গ্রন্থাগারকে যারা পাঠকদের কাছে সঠিকভাবে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলেন তাঁরাই থাকেন সব সময় অবহেলায়। বলা হয়ে থাকে একটি দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে সেদেশের মানুষের জ্ঞান চর্চার উপর। বর্তমান সময়ে আমরা জ্ঞান চর্চায় আগ্রহী হয়েছি বলেই আমরা আজ উন্নতির মহাসড়কে পদার্পণ করেছি। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ উদ্দ্যোগে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করছে। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলোতে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লাগছে। যা আনন্দের। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও গ্রন্থাগারের গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে গ্রন্থাগার সম্বন্ধে বলা হয়েছে “গ্রন্থাগার সভ্যতার দর্পণ বলে বিবেচিত। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রন্থাগার যেমন একটি দেশের সার্বিক সাংস্কৃতিক বিকাশগত মান নির্ধারণের অন্যতম সূচক। ” তারপরেও গ্রন্থাগারগুলো অবেহেলিত তারচেয়েও বেশি অবেহেলার শিকার গ্রন্থাগারিকরা।
সচেতন কোন মানুষই গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিকতা পেশাকে অসন্মান করে না কিন্তু গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিকতা পেশার উন্নয়নের কথা উঠলে সবাই যেন চুপ। একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে যেমনভাবে গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিকতা পেশার মূল্যায়ন হওয়া উচিত ছিল সেইভাবে গ্রন্থাগারিকতা পেশার মূল্যায়ন হয়নি বিধায় সমাজে গ্রন্থাগারিকতা পেশা এখনও অবহেলিত। গ্রন্থাগারিকরা নিজেদের প্রজ্ঞা ও শ্রম দিয়ে একটি গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন এবং তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। একটি গ্রন্থাগার থেকে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, আমলাসহ সর্বস্থরের জনগন তথ্যসেবা লাভ করেন এবং নিজেকে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে নেপথ্যে কাজ করা গ্রন্থাগারিকরা আজও অবেহেলিত। গ্রন্থাগারিকরা যে পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন সেই পদেই তাদের অবসরে যেতে হয়। চাকুরীজীবনে তাঁরা কোন পদোন্নতি পান না অথচ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেই আধুনিক বালাদেশে বিনির্মিত হচ্ছে।
গ্রন্থাগারিকতা পেশার মর্যাদা ও সম্মানজনক বেতন স্কেল প্রাপ্তির অন্যতম বাঁধা হল গ্রন্থাগারিকদের সমন্বিত নিয়োগবিধি না থাকা। ফলে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও সায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিকদের নিয়োগবিধি ভিন্নতর। দেখা যায় কোন প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিকের বেতন স্কেল ষষ্ঠ গ্রেড, কোথাও নবম গ্রেড, কোথাও আবার বারো বা তেরোতম গ্রেড। এছাড়া স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিকদের বৈষম্য সৃষ্টির জন্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এক এক সময় একএক ধরনের পরস্পর বিরোধী নীতিমালা ও প্রজ্ঞাপনও অনেকটা দায়ী। এ ধরনের পরস্পর বিরোধী নীতিমালা ও প্রজ্ঞাপন গ্রন্থাগারিকদের মর্যাদার দিক থেকে অনেক পিছনে ফেলে রেখেছে। এজন্যে এই পেশায় তরুন মেধাবী গ্রন্থাগার পেশাজীবীরা নিরুৎসাহিত হয়ে এই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। যারা এই পেশায় থাকছেন তাঁরা অবহেলিত হয়ে এক মানসিক যন্ত্রণা ও হীন মন্যতা নিয়ে গ্রন্থাগার সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন।
গ্রন্থাগারিকদের বৈষম্য নিরসনে গ্রন্থাগারিকদের সমন্বিত নিয়োগবিধি এখন সময়ের দাবী। গ্রন্থাগারিকদের সমন্বিত নিয়োগবিধি প্রণয়ন হলে গ্রন্থাগারিকদের পদোন্নতি ও বেতন বৈষম্য কিছুটা নিরসন হবে। আমরা দেখতে পায় সমন্বিত নিয়োগ বিধি থাকার কারনে একজন অফিস সহকারীও এক সময় উপসচিব পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। গ্রন্থাগারিকদের সমন্বিত নিয়োগবিধি থাকলে পদোন্নতি নিশ্চিত হবে যা চাকুরি জীবনের একটি কাঙ্ক্ষিত বিষয়।
এছাড়া স্কুল ও কলেজ গ্রন্থাগারিদের বৈষম্য নিরসনে জাতীয় শিক্ষানীতির ২০১০ এর ২০তম অধ্যায়ের কৌশল অংশের ১০-১৩ নম্বরের ধারাগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। যা নিম্নরূপ –
১০. নীতি, পরিকল্পনা ও সমন্বয়গত সমস্যার সমাধান ও উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি সংবিধিবদ্ধ এবং সার্বিক মর্যাদাসম্পন্ন কার্যকর গ্রন্থাগার কাউন্সিল স্থাপন করা হবে।
১১. মন্ত্রণালয়/ বিভাগ, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরকে নিজ নিজ প্রশাসনাধীন গ্রন্থাগার ও তথ্যকেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন ও নতুন গ্রন্থাগার স্থাপনায় কাউন্সিলের পরামর্শ অনুযায়ী নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে।
১২. প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক, সহ গ্রন্থাগারিক সহ অন্যান্য পদ সৃষ্টি করা ও তাদের যথার্থ মর্যাদা নির্ধারণ করা হবে।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারো ৫ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস উদযাপিত হতে যাচ্ছে। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার ঘরে ঘরে গ্রন্থাগার’। গ্রন্থাগার সমাজের আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করে আর এর পরিচালনা করে গ্রন্থাগারিকগণ। গ্রন্থাগারিকদের বৈষম্য নিরসন ছাড়া এবারের গ্রন্থাগার দিবসের প্রতিপাদ্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হতে পারে গ্রন্থাগারিকদের দাবী আদায়ের অন্যতম দিন। এদিন গ্রন্থাগারিক পেশাজীবী সমাজ সভা সেমিনার ও র্যালী করে তাদের দাবীগুলো কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরতে পারে। মুজিব বর্ষে বাংলাদেশের সকল গ্রন্থাগার পেশাজীবীদের সকল বৈষম্য নিরসন হোক। এগিয়ে যাক গ্রন্থাগার আন্দোলন, এগিয়ে যাক গ্রন্থাগারিকতা পেশা।
লেখক: কনক মনিরুল ইসলাম
- লাইব্রেরিয়ান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
- সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, লাইব্রেরিয়ান ভয়েস।